সাঁওতালদের বাড়ি পোড়ানোয় পুলিশের সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখছে পুলিশ

শাহরিয়ার শরীফ
2016.12.16
ঢাকা থেকে
সাঁওতালদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখছেন একজন পুলিশ সদস্য। সাঁওতালদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখছেন একজন পুলিশ সদস্য। নভেম্বর ০৬, ২০১৬।
স্টার মেইল

সাঁওতালদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা তদন্তে হাই কোর্টের নির্দেশের পর বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে পুলিশ। ভিডিওচিত্র এবং আলোকচিত্রে কিছু পুলিশের উপস্থিতি ঘটনার সঙ্গে একদিকে সমালোচনার ঝড় তুলেছে, অন্যদিকে তাদের অংশগ্রহণ অনেকটাই নিশ্চিত করেছে।

গত বুধবার হাই কোর্ট তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার একদিনের মাথায় এ বিষয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন পুলিশ বাহিনীর প্রধান এ কে এম শহীদুল হক। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীতে আগুনের ঘটনায় তদন্ত চলছে।

গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত শহীদের স্মৃতি স্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কথা জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছে।

তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, পুলিশের এই কাজটি আরও আগেই করা উচিত ছিল। তাঁদের মতে, উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক নড়াচড়া হচ্ছে। বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আর নেই।

তাঁরা বলছেন, প্রথমদিকে পুলিশ সাঁওতালদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল, আহত ​চারজন সাঁওতালকে গ্রেপ্তার করে হাতকড়া পরিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে রেখেছিল। পরে আদালতের নির্দেশে তাঁদের হাতকড়া খুলে দেওয়া হয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে সাঁওতালরাও মামলা করার সুযোগ পায়।

পুলিশের আইজি গতকাল জানান, সেখানে কারা আগুন লাগিয়েছে, তা পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে। দোষী যেই হোক না কেন তাকে কোনও ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানান শহীদুল হক।

আইজিপি আরও জানান, সাঁওতাল পল্লীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনা দেশের সকল সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিছুদিন আগে বিদেশি একটি টিভি চ্যানেলের ফুটেজের ওপর ভিত্তি করে দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে যে, পুলিশ সাঁওতাল পল্লীতে আগুন দিয়েছে।

তিনি আরও জানান, ওই গুজবটি পুলিশের নজরে এসেছে। ইতিমধ্যে হাইকোর্ট ওই আগুনের ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত করতে বলেছেন। তারই ভিত্তিতে বর্তমানে তদন্ত চলছে।

এক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। তবে দোষী যেই হোক না কেন তাকে অবশ্যই শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। তাতে পুলিশ হোক আর যেই হোক। এমন অপরাধ বরদাশত করা হবে না।

গত ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা বিরোধপূর্ণ জমি থেকে কয়েকশ সাঁওতাল পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। সে সময় দুপক্ষের মাঝে সংঘর্ষ বাঁধে এবং সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট, ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়। চিনিকল শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালালে তিনজন সাঁওতাল নিহত হন।

এদিকে বিরোধপূর্ণ জমি থেকে উচ্ছেদের সময় সাঁওতালদের ঘরে আগুন দেওয়ার বিষয়টি তদন্ত করতে গত বুধবার সেখানকার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

হাইকোর্টের ওই আদেশে সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার সঙ্গে পুলিশ জড়িত কিনা এবং কারা ওই ঘটনার জন্য দায়ী—তা খতিয়ে দেখে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কমপক্ষে পুলিশ সুপার মর্যাদার কর্মকর্তার মাধ্যমে এই তদন্ত তদারকের ব্যবস্থা করতেও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজিকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।​

বিরোধপূর্ণ জমি থেকে উচ্ছেদের সময় সাঁওতালদের ঘরে পুলিশের আগুন দেওয়ার ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ভিডিওতে দেখা যায়, সাঁওতাল পল্লীর ভেতরে পুলিশ সদস্যরা গুলি ছুড়ছেন। কয়েকজন পুলিশ সদস্য একটি ঘরে লাথি মারছেন এবং পরে এক পুলিশ সদস্য ওই ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) হাইকোর্টে একটি সম্পূরক আবেদন করলে এসব নির্দেশ আসে।

“এটা যেহেতু কোর্টের আওতাধীন বিষয় এবং কোর্ট যেহেতু তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সেহেতু বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য না করাই শ্রেয়। আমরা এখন কোর্টের নির্দেশ কতটুকু বাস্তবায়ন হয়, সেটি দেখার অপেক্ষায় আছি,” বেনারকে জানান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নূর খান।

এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, এখন পুলিশ কী করল বা কী বলল, তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে। এ ছাড়া পুলিশ যে তদন্ত করবে সেখানেও কমপক্ষে এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিতে বলা হয়েছে। অতএব, বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন।

সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি ফিলিমিন বাসকে বেনারকে বলেন, “বিলম্বে হলেও তদন্তের এই নির্দেশে আমরা সন্তুষ্ট। প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসুক এবং সত্যিকার দোষীরা শাস্তি পাক—এটাই আমাদের একমাত্র প্রত্যাশা।”

​ওই সাঁওতাল নেতা বলেন, সুষ্ঠু তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে পুলিশ ও প্রভাবশালীরা মিলেই সেদিন নিরীহ সাঁওতালদের নির্যাতন করেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৪ সালের দিকে তৎকালীন সরকার গোবিন্দগঞ্জে এক হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে। তখনই এ সব জমির মালিকদের আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। তবে শর্ত ছিল, চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ ছাড়া ওই জমিতে অন্য কোনো ফসল চাষের জন্য ইজারা দিতে পারবে না।

চিনিকল কর্তৃপক্ষ অন্য ফসল চাষের জন্য জমি ইজারা দিয়েছে বলে অভিযোগ তোলে সাঁওতালরা। এর প্রতিবাদ হিসেবে তাঁরা ওই জমিতে ঘরবাড়ি তুলে বসবাস শুরু করে। মিল কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলে গত ৬ নভেম্বর সংঘর্ষ, হতাহত হওয়া ও বাড়িঘরে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।