সাঁওতালদের ওপর পুলিশের হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে
2016.12.13
ঢাকা থেকে
দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল পল্লীতে উচ্ছেদ অভিযানের সময় পুলিশের আগুন দেওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই ইউটিউব ও ফেইসবুকে ভিডিওটি শেয়ার করছেন।
ভিডিওর একটি অংশে কয়েকটি ঘরে আগুন দিতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের। তাদের মাথায় ছিল হেলমেট, একজনের পোশাকের পিঠে ডিবি ও আরেকজনের পুলিশ লেখা ছিল। এ ছাড়া সাঁওতালদের দিকে পুলিশকে গুলি করতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বেনারকে বলেন, দরিদ্র সাঁওতালদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার যে দৃশ্য দেখা গেছে, তা দুঃখজনক। মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে বিষয়টি তদন্ত করা হবে। এতে কারও দোষ বা সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবে মানবাধিকার কমিশন।
দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও অনলাইন পোর্টালে ওই ভিডিওর ওপর ভিত্তি করে ইতিমধ্যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রকাশ হওয়ার পর পুলিশ কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে। উচ্চ আদালতের একজন আইনজীবী এ ঘটনাকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
ভিডিও শেয়ার দিয়ে উচ্চ আদালতের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান খান লিখেছেন, “আমি আল জাজিরার নির্লজ্জ প্রপাগান্ডার তীব্র প্রতিবাদ করছি। সাঁওতালদের ভিটেমাটিতে আমাদের সৎ, সাহসী ও দেশ্রপ্রেমিক পুলিশ আগুন লাগাতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আমি নিশ্চিত, পুলিশ মূলত আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিল।”
এরপর তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রণীত আইনে দেওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা তুলে ধরেন এবং দেখান, সেখানে আগুন লাগানোর অপরাধের কথাও বলা হয়েছে।
এক দুর্বৃত্ত সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন লাগাচ্ছে, কাছেই পুলিশ সদস্যরা। নভেম্বর ০৬, ২০১৬। স্টার মেইল।
“সাঁওতালদের এভাবে উচ্ছেদ করা আইন ও সংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থি,” বেনারকে জানান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি বলেন, কমিশনের পক্ষ থেকে সরেজমিন ওই এলাকা পরির্দশনের সময় স্থানীয়রা জানিয়েছিলেন যে, পুলিশের উপস্থিতিতে এলাকার প্রভাবশালীরা সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। কিন্তু ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পুলিশই আগুন লাগাচ্ছে।
তবে পুলিশ বলছে, তাদের সদস্যরা আগুন দেয়নি, ভিডিওর বিষয়টি তাদের জানা নেই।
গাইবান্ধার পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, তিনি ভিডিওটি দেখেছেন। এটা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তবে পুলিশের কোনও সদস্য সাঁওতালদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে কিনা, সেটি এই মুহুর্তে তিনি বলতে পারছেন না।
সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা বিরোধপূর্ণ জমি থেকে কয়েকশ সাঁওতাল পরিবারকে গত ৬ নভেম্বর উচ্ছেদ করা হয়। সে সময় সংঘর্ষ বাঁধে এবং সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট, ভাংচুরের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়।
চিনিকল শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। ওই ঘটনায় নিহত হন তিন সাঁওতাল, আহত হন অনেকেই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপর গুলিবর্ষণের ওই ঘটনায় সমালোচনা হয় দেশে–বিদেশে। উচ্চ আদালতে কমপক্ষে দুটি রিট আবেদন হয় সাঁওতালদের পক্ষে।
এ ঘটনায় পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে গোবিন্দগঞ্জ থানায় ৪২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং তিন থেকে চারশজনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে মামলা করা হয়। এর মধ্যে চারজন সাঁওতালকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়, যাঁদের তিনজন চিকিৎসাধীন ছিলেন হাতকড়া পরা অবস্থায়। হাইকোর্ট তাঁদের হাতকড়া খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
এ ছাড়া পৃথক এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাঁওতালদের রোপন করা ধান কেটে নিতে সহায়তা করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
স্থানীয় বাসিন্দা আবু জাফর (৩৫) বেনারকে বলেন, সাহেবগঞ্জ এলাকার আটটি গ্রামে প্রায় দেড় হাজার সাঁওতাল পরিবার (৯০০০ মানুষ) বসবাস করেন। স্থানীয় প্রভাবশালী ও পুলিশের ভয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৮শ সাঁওতাল খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছেন।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, সরকার ১৯৫৪ সালের দিকে গোবিন্দগঞ্জে এক হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে । তখনই এ সব জমির মালিকদের আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। তবে শর্ত ছিল, চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ ছাড়া ওই জমিতে অন্য কোনো ফসল চাষের জন্য ইজারা দিতে পারবে না।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, চিনিকল কর্তৃপক্ষ অন্য ফসল চাষের জন্য জমি ইজারা দিয়েছে। প্রতিবাদ হিসেবে সাওতাঁলেরা ওই জমিতে ঘরবাড়ি তুলেছেন। গত ৬ নভেম্বর প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলে দুই পক্ষের সংঘর্ষ বাধে।
ঘটনার নয়দিন পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়া সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, “কিছু স্বার্থান্বেষী ভূমিদস্যু ওই ঘটনায় ইন্ধন দেয়। নিরীহ ও সহজ সরল প্রকৃতির সাঁওতালেরা পরিস্থিতির শিকার। তাঁদের প্রতি সরকার অত্যন্ত সহানুভূতিশীল।”
সচিব সরকারের পক্ষ থেকে হতাহতদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দেন। প্রয়োজনে ভূমিহীন সাঁওতালদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার কথা বলেন। তবে তিনি বলেন, সরকারি মালিকানাধীন চিনি কলের জায়গা দখল করে কাউকে থাকতে দেওয়া হবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ইতিমধ্যে সাঁওতালদের পুণর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাঁদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে হামলায় পুলিশের সম্পৃক্ততার প্রমাণসহ যে ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, তাতে সরকার ও এই বাহিনীর সদস্যদের অনেকেই বিব্রত হয়েছেন।