সামরিক চুক্তির পর সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের বৃহত্তম বিনিয়োগ সম্ভাবনা

পুলক ঘটক
2019.03.07
ঢাকা
190307_Saudi_Investment_1000.jpg প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সৌদি আরবের সাথে দুটি চুক্তি ও চারটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। ৭ মার্চ ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

সামরিক চুক্তির পর দেশের জনশক্তি রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরবের কাছ থেকে এবার এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ সরকার।

দেশটির সঙ্গে বৃহস্পতিবার দুইটি চুক্তি এবং চারটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ।

এর আগে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ইয়েমেন সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইন অপসারণ করার জন্য বাংলাদেশে থেকে একহাজার আটশ’ দক্ষ সৈনিক নেবে সৌদি আরব।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)’র নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, “সৌদি থেকে বিভিন্ন খাতে পর্যায়ক্রমে ১৫ থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আসতে পারে।”

বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বাংলাদেশে সফররত সৌদি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

সৌদি সরকারের দুই মন্ত্রীর নেতৃত্বে ৫২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার একদিনের সফরে ঢাকায় আসলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে চুক্তিগুলো স্বাক্ষর হয়।

সৌদি আরবের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ মন্ত্রী মাজেদ বিন আব্দুল্লাহ আল-কাসাবি এবং অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন মেজইয়ে আলতাইজরি প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

সম্প্রতি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ভারত, পাকিস্তান ও চীন ভ্রমণ করার পর দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে বিনিয়োগ চুক্তি করল সৌদি আরব।

তবে সৌদি আরবের সাথে এ ধরনের সম্পর্কে সন্তুষ্ট নন দেশের মানবাধিকার কর্মীরা। বিশেষ করে যখন সৌদি রাজপরিবারের সমালোচক ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে নির্মমভাবে হত্যার দায় স্বীকার এবং নারী ও শিশুসহ ইয়েমেনের নিরপরাধ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি।

এ প্রসঙ্গে শুরুতে কথা বলতে চাননি মানবাধিকার কর্মী নূর খান। পরে তিনি বেনারকে বলেন, বলুন তো মানবাধিকার ইস্যুতে আমার দেশ কতটা ভালো? আমাদের সাথে তাদের মিল আছে বলেই তাদের সাথে এমন সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে।”

ইতিবাচক অগ্রগতি

সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় গত মাসে দেশটির সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তি সম্পাদনের পর এত বড় বিনিয়োগ প্রস্তাবনাকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

“দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা তৈরি না হলে সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার চুক্তি সাধারণত হয় না। একটি সামরিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের অল্পদিনের ব্যবধানে এত বড় বিনিনিয়োগ প্রস্তাবনা সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের একটি বড় নিদর্শন,” বেনারকে বলেছেন মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুর রশিদ।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)’র বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “এই বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করবে।”

বিডার চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম বলেন, “৩০ বছর আগে ইসলামী ব্যাংকে একটি ক্ষুদ্র বিনিয়োগের পর সৌদি আরবের সাথে এই প্রথম এতবড় বিনিয়োগ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।”

ব্রিফিংয়ের পর বেনার প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেন, “এই বিনিয়োগ প্রস্তাবনা শুধুমাত্র বাণিজ্যিক লাভালাভের দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের বন্ধুত্বের নিবিড়তা একটি নতুন মাত্রা পাবে।”

তিনি বলেন, “ইউরোপ ও আমেরিকায় তাদের বিনিয়োগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখন তারা পূর্বের দিকে ঝুঁকেছে এবং বাংলাদেশ এর জন্য সবচেয়ে সঠিক জায়গা।”

আমিনুল ইসলাম বলছিলেন, “তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে অর্থনীতির বহুমাত্রিক ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে চাচ্ছে সৌদি আরব। তাদের আগ্রহের সঙ্গে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার আগ্রহ মিলে যায়। তাই বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের প্রভুত সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।”

সম্পর্কের নতুন দিগন্ত

বিশ্বের মধ্যে সৌদি আরবেই সর্বাধিক সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। দেশটিতে বর্তমানে ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মরত। এখনও প্রতি মাসে ২০ হাজারের বেশি মানুষ দেশটিতে যাচ্ছেন।

বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানরত সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ বেনারকে বলেন, “আমরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এখন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বিনিয়োগের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি।”

তিনি বলেন, “গত সাড়ে তিন বছরে রিয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার দফা রাষ্ট্রীয় সফরের মধ্য দিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন মোড় নিয়েছে। বাংলাদেশের দৃঢ় অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও সৌদি আরবের শক্তিশালী অর্থনীতি কাজে লাগিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক নতুন দিগন্ত পেয়েছে।”

যেসব চুক্তি ও সমঝোতা

সৌদি আরব বাংলাদেশে জ্বালানি, তেল পরিশোধনাগার, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, সৌর বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য বিনিয়োগ করবে। এজন্য চুক্তি হয়েছে দুইটি এবং সমঝোতা স্মারক হয়েছে চারটি।

আমিনুল ইসলাম বলেছেন, “সৌদি আরবের বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে দুই হাজার একর জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। তারা বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, উড়োজাহাজকে গুরুত্ব দিয়ে ১৬ প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে।”

১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র (সোলার আইপিপি) নির্মাণে সৌদি আরবের আলফানার কোম্পানির সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি)।

ট্রান্সফরমার ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উৎপাদনে সৌদি কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশনের সঙ্গে চুক্তি করেছে জেনারেল ইলেকট্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড।

এ ছাড়া বাংলাদেশের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং সৌদির আল মাম ট্রেডিং এস্টেটের মধ্যে জনশক্তি রপ্তানি বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।

ইউরিয়া ফরমালডিহাইড-৮৫ প্ল্যান্ট নির্মাণে সৌদি আরবের ইউসুফ আল রাজি কনস্ট্রাকশন এস্টেটের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন।

‘সৌদি-বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব বায়ো-মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সৌদি আরবের আল আফালিক গ্রুপ (এএইচ গ্রুপ) এবং বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক হয়েছে।

বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি) এবং রিয়াদ ক্যাবলস গ্রুপ অব কোম্পানির মধ্যে তার উৎপাদনের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক হয়েছে।

প্রতিবেদেন তথ্য দিয়ে সহাযতা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।