মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য থেকে নারীর অবয়ব বাদ, প্রতিবাদে কর্মসূচি
2017.12.22
ঢাকা
নারী–পুরুষের সমতা অর্জনে জাতীয় প্রচেষ্টা এবং শিক্ষাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির মধ্যে ফের দুঃসংবাদ এসেছে একটি ভাস্কর্যের অবয়ব পরিবর্তনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। হাওর অঞ্চলে নির্মাণাধীন ওই ভাস্কর্যের নারী অবয়বটি পরিবর্তন করে সেটির মুখে দাঁড়ি-গোঁফ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে এটাকে পুরুষ ভাস্কর্য বলে মনে হয়।
বিস্ময়কর এই ঘটনাটি ঘটেছে কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলা পরিষদ চত্বরে স্থাপিত ভাস্কর্য ঘিরে। জেলা পরিষদের অর্থায়নে মুক্তিযুদ্ধের এই ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। ভাস্কর্যে তিনটি ফিগারের দুটি ছিল পুরুষের, একটি নারীর। মুক্তিযুদ্ধে নারী–পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে মুক্তিযুদ্ধ করেছে এটা তারই প্রতীক। এখন তিনটি ফিগারই পুরুষের করা হয়েছে।
গত মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে স্থাপিত গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরানো হয়। জাতীয় ঈদগাহের কাছাকাছি স্থানে এটি স্থাপন করায় হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো এটা অপসারণে আন্দোলন শুরু করে। অবশেষে সরকার তাদের ওই দাবি মেনে নেয়।
এবার কিশোরগঞ্জে ভাস্কর্যের অবয়ব পরিবর্তনেও সরকারি দলের স্থানীয় নেতাদের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
“চাপের মুখে নারী ভাস্কর্যটির অবয়ব পরিবর্তন করতে হচ্ছে। সরকারি দলের স্থানীয় নেতারা আমাকে এটা করতে বলেছেন। তবে এ বিষয়ে জেলা পরিষদের অনুমতি নেওয়া হয়নি,” বেনারকে জানান ভাস্কর ও ঠিকাদার সুষেণ আচার্য।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তাড়াইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আজিজুল হক বেনারকে বলেন, “ভাস্কর্যটির প্রায় ১৫০ ফুট দূরে মাদ্রাসা ও মসজিদ রয়েছে। সেখানে মৃতদের জানাজা পড়ানো হয়। তাই এই এলাকার কাছাকাছি ভাস্কর্য স্থাপন করা নিয়ে এলাকাবাসীদের অনেকেই আপত্তি তোলেন। সে জন্য মসজিদের দিকে ফেরানো নারী মূর্তিটির মুখ বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিতে বলেছিলাম।”
“আমি নারী ভাস্কর্যকে পুরুষ বানাতে বলিনি,” জানান আজিজুল হক।
কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রকৌশলী এএসএম লুৎফর রহমান বেনারকে বলেন, তাড়াইলে ভাস্কর্যের নারী মূর্তিকে পুরুষে পরিবর্তনের বিষয়ে ঠিকাদার বা ভাস্কর পরিষদের অনুমতি নেননি।
এদিকে ভাস্কর্যের আকৃতি পরিবর্তনের উদ্যোগে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে জেলার মহিলা পরিষদসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কিশোরগঞ্জ জেলা শাখা গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এর প্রতিবাদে ২৪ ডিসেম্বর রোববার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধনের ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি ওই দিন তাঁরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেবেন।
“বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অবদান কোনো অংশ কম ছিল না। নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এ জন্য সব ভাস্কর্যে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অবয়ব রাখা হয়,” সংবাদ সম্মেলনে জানান মহিলা পরিষদের জেলা সভাপতি মায়া ভৌমিক।
শহরের সমবায় ভবনে মহিলা পরিষদের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন মায়া ভৌমিক। তিনি বলেন, করিমগঞ্জ উপজেলায়ও নারী–পুরুষের ভাস্কর্য করা হয়েছে। তাড়াইলে স্থাপিত ভাস্কর্যেও মুক্তিযুদ্ধে নারী–পুরুষের অবদান ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কী কারণে ভাস্কর্য নির্মাণের শেষ পর্যায়ে এসে নারী মূর্তিটিকে পুরুষ বানানো হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আতিয়া হোসেন, সদস্য সুলতানা রাজিয়া, হামিদা বেগম, জেলা মানবাধিকার আইনজীবী পরিষদের সভাপতি গাজি মাহমুদ, নারী নেত্রী খুজিস্তা বেগম জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আবু খালেদ পাঠান প্রমুখ।
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, তাড়াইল উপজেলা পরিষদ চত্বরে ৩৭ ফুট উঁচু ও ৩০ ফুট প্রশস্ত মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যটি নির্মাণ হচ্ছে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের শেষের দিকে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর ভাস্কর্যের কাজ শেষ হওয়ার কথা।
‘শম্পা এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণের দায়িত্ব পায়। উঁচু বেদির ওপর দুজন রাইফেলধারী পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় পতাকা হাতে এক নারী মুক্তিযোদ্ধার মূর্তি নির্মাণ করা হচ্ছিল। এর নিচের দিকে চতুষ্কোণ বেদির দুই পাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল আর দুই পাশে সাত বীরশ্রেষ্ঠের ম্যুরাল রয়েছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকায় বসবাসরত কিশোরগঞ্জের তাড়াইল এলাকার বাসিন্দা ও ঢাকায় বুটিক শপের মালিক তামান্না হক বেনারকে বলেন, এ ধরনের পরিবর্তন মেনে নেওয়া হবে না। এটা নারীর প্রতি অসম্মান ও অবমাননা ছাড়া আর কিছু নয়।
“এই কর্মকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়ও চরম আঘাত হানছে। আমরা বলতে চাই, ভাস্কর্যের কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। পুরুষের সঙ্গে নারী মূর্তিই থাকবে। এটি মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতীক,” জানান তামান্না।