ভোটের রাজনীতির কারণে এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ টিকে আছে বাংলাদেশে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.11.22
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের মানববন্ধন। নভেম্বর ০৭, ২০১৬। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের মানববন্ধন। নভেম্বর ০৭, ২০১৬।
স্টার মেইল

ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক অবস্থান নিয়ে দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সরকার সমর্থক বা সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেকের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। তথ্যপ্রমাণ ও রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজনৈতিক হিসাব মেলাতে গিয়ে গঠনতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেকটাই সরে গেছে দলটি।

অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করা অনেকেই মনে করছেন, গত ৬৭ বছরের আওয়ামী লীগ তার ঘোষিত মূলনীতি থেকে সরে এসেছে। নাসিরনগরে হিন্দু ও সাঁওতালপল্লিতে হামলার ঘটনায় বিএনপি উল্টো আওয়ামী লীগকে সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে গালমন্দ করছে।

এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করলেও রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করার চিন্তা এই সরকারের নেই।

রাষ্ট্রধর্মের আলোচনা যেভাবে শুরু

গত ১২ নভেম্বর ঢাকায় এক সেমিনারে দলটির নবগঠিত সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, “সুযোগ পেলে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা হবে।” তিনি বাংলাদেশে সামরিক শাসকেরা কীভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি ও সমাজকে কলুষিত করেছেন, তারও চিত্র তুলে ধরেন ওই বক্তৃতায়।

ড. রাজ্জাক বলেন, কৌশলগত কারণে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে রাখা হয়েছে। সময় পেলে সংবিধান থেকে ইসলাম তুলে দেওয়া হবে।

যদিও তাঁর ওই বক্তব্য সরকার বা সরকারি দল গ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “দলের অনুমোদন ছাড়া স্পর্শকাতর এই বিষয়ে ওনার (ড. রাজ্জাক) মন্তব্য করা ঠিক হয়নি। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখা আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ মূলনীতির সঙ্গে মেলে না, কিন্তু এটা রাজনৈতিক বাস্তবতা।”

ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামে যাত্রা

সব ধর্মের মানুষের সম্মিলিত সংগ্রামে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতা পান সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান। তিনি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দিয়ে সেখানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা’ স্থাপন করেন।

এরপর আরেক সামরিক শাসক এইচএম এরশাদ অষ্টম সংশোধনী এনে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করেন, যা এখনো বহাল আছে। ১৯৮৮ সালে এরশাদ যখন রাষ্ট্রধর্ম চালু করেন, তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আট দল ও পাঁচ দলীয় বাম জোট তার প্রতিবাদে হরতাল পালন করেছিল।

এরশাদের পতন হওয়ার পর রাষ্ট্রধর্মের বিধান বাদ দেওয়ার দাবি বিভিন্ন সময়ে উঠলেও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগও এতে হাত দেয়নি। ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীতে ’৭২-এর চার মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনে দলটি। কিন্তু ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ আগের মতোই থেকে যায়।

দেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে পরিবর্তনের এই বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২৮ বছর আগে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির’ পক্ষে ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন। এ বছরের ২৭ মার্চ ওই আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।

রিট আবেদনকারীদের যুক্তি ছিল, বাংলাদেশে নানা ধর্মবিশ্বাসের মানুষ বাস করে। এখানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে অন্যান্য ধর্মকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

ওই রিট আবেদন বাতিল করে দেওয়া রায়ে বলা হয়, এমন কোনো ‘কমিটির’ রিট আবেদন করার ‘এখতিয়ার নেই’ বলে সেটি খারিজ করা হল।

ব্যক্তিগত অবস্থান, দলগত নয়

ড. রাজ্জাকের বক্তব্য সঠিক নয় বলে মনে করে তাঁর দল। এ বিষয়ে ফের জানতে চাইলে ড. রাজ্জাক বেনারকে বলেন, “আমি যা বিশ্বাস করি তাই বলেছি। যদি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রধর্মের বিষয়ে জনমত সৃষ্টি হয়, তাহলে তা পরিবর্তন হতে পারে।”

এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন, সরকার বা আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা কিংবা সংবিধান সংশোধনের চিন্তা করছে না। “ওটি তাঁর (আব্দুর রাজ্জাক) ব্যক্তিগত মত। দলের একজন নেতা ব্যক্তিগত অভিমত দিতেই পারেন,” বেনারকে জানান ওবায়দুল কাদের।

তবে ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন দেশে লেখক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় জাতীয় কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বেনারকে বলেন, “আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যে ভাষায় কথা বলছেন, তা বিএনপি–জামায়াত বলতে পারে। উনি এমন কথা বলে নিজেকে ও অসাম্প্রদায়িক দল আওয়ামী লীগকে বিএনপি–জামায়াতের কাতারে দাঁড় করিয়েছেন।”

ধর্মভিত্তিক দলগুলো তৎপর

ড. রাজ্জাক রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর নড়েচড়ে ওঠে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। বাংলাদেশ ইসলামি আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, ওলামা লীগসহ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন ড. রাজ্জাককে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানায়।

গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর হজ আর তাবলিগের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন আরেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সমালোচনা ও চাপের মুখে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে বাদ দেওয়া হয় মন্ত্রিসভা থেকে, সংসদ থেকেও তিনি পদত্যাগ করেন। ওই ঘটনার পর এই প্রথম ড. রাজ্জাক রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কথা বললেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আতাউর রহমান বেনারকে বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আওয়ামী লীগ এখন বিএনপি–জামায়াতের চেয়েও নিজেদের অনেক বেশি ইসলামপন্থী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। ভোটের রাজনীতির কারণেই দলটির এই অবস্থান বলে মনে করেন তিনি।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে যা আছে

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে দলের গঠনতন্ত্রের মূলনীতি অংশে বলা আছে, “বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সকল ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত সমাজ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মূলনীতি।”

আওয়ামী লীগের পতাকায় চারটি তারকা আছে চার মূলনীতির প্রতীক হিসেবে—জাতীয়তাবাদ (বাঙালি), গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, গণতন্ত্র অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। দলটি বেশ আগেই সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ করেছে, ধারণ করেছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। বাঙালি জাতীয়তাবাদও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আপস করে চলেছে। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর চার মূলনীতি থেকে সরে এসে এরশাদ–প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্মকে রক্ষাকবচ হিসেবে মেনে নিচ্ছে।

সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক!

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাসিরনগরে হেফাজতে ইসলাম ও আহলে সুন্নতের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সদ্ভাবের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। সেখানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার মূলে যে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল সক্রিয় ছিল, সেটি পুলিশ, মানবাধিকার কমিশন ও নাগরিক সমাজের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এমনকি আওয়ামী লীগের তিন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে।

কয়েক বছর আগেও আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজত সরকার উৎখাতের ঘোষণা দিলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। গত দুই বছরে সরকারের সঙ্গে সেই হেফাজতের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

“মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় বসে কোনো দায়-দায়িত্ব নিচ্ছে না। তারা সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, গোঁড়া, ধর্মান্ধ ও নারী বিদ্বেষীদের সঙ্গে আপস করছে,” বেনারকে জানান সুলতানা কামাল।

আওয়ামী লীগের এই অবস্থানের সঙ্গে ভোটের রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, “বেশি ভোট পাওয়ার আশায় সারা বছর দলের নেতাদের অনেকেই নিজেদের ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু তারা কেন তারা ভাবেন না যে, তাঁরা যত বেশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে যাবেন, তত কম ভোট কম পাবেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।