বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগের ১২ ঘন্টার মধ্যে আল্লামা শফীর ইন্তেকাল

পুলক ঘটক
2020.09.18
ঢাকা
বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগের ১২ ঘন্টার মধ্যে আল্লামা শফীর ইন্তেকাল 1000 হেফাজত আমির শাহ আহমদ শফি। ফাইল ফটো জুলাই ৭, ২০১৭।
বেনার নিউজ।

ছাত্র বিক্ষোভের মুখে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতারিম (মহাপরিচালক) পদ থেকে পদত্যাগের ১২ ঘন্টার মাথায় ইন্তেকাল করেছেন হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী (১০৩)। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত একটার দিকে দেশের সবচেয়ে​ বড় কওমি মাদ্রাসাটির মজলিশে শূরার বৈঠকে তিনি পদত্যাগ করেন।

“সভা শেষে শুক্রবার ভোরে অ্যাম্বুলেন্সে করে চট্টগ্রাম শহরের একটি হাসপাতালে তাঁকে নেওয়া হয়েছিল। শুক্রবার বিকেলে তাঁকে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তিনি মারা যান,” বেনারকে জানান দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক শেখ আহমদ।

এর আগে মাদ্রাসাটির মজলিশে শূরা সদস্য আল্লামা সালাউদ্দিন নানুপুরী বেনারকে বলেছিলেন, “অসুস্থতার কারণে আল্লামা আহমদ শফী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। তবে উনি আমাদের উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন।”

“তিনি মহাপরিচালকের দায়িত্ব মজলিশে শূরার ওপর অর্পণ করেছেন। শূরা সদস্যরা পরবর্তী সময়ে মহাপরিচালকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন,” জানিয়েছেন সালাউদ্দিন নানপুরী।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আল্লামা শফীর পক্ষের একজন শিক্ষককে উদ্ধৃত করে বিবিসি বাংলা বলেছে, “শতবর্ষী আহমদ শফী খুবই অসুস্থ ছিলেন। একজন গুরুতর অসুস্থ মানুষকে বিক্ষোভের মুখে জোর করে বৈঠকে রেখে একতরফা সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।”

এর আগে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে মাদ্রাসাটির শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ছেলে মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষা সচিব মাওলানা আনাস মাদানী এবং শফীর অনুসারী আরেক শিক্ষক মাওলানা নূরুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়।

আল্লামা শফীর পদত্যাগ এবং তার ছেলে আনাস মাদানীকে বহিষ্কারসহ পাঁচ দফা দাবিতে বুধবার থেকে বিক্ষোভ করছিল শিক্ষার্থীরা।

তাদের দাবির মধ্যে ছিল; ছাত্রদের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ–সুবিধা প্রদান ও হয়রানি বন্ধ, শিক্ষকদের পূর্ণ অধিকার ও নিয়োগ-পদত্যাগ শূরার কাছে পূর্ণ ন্যস্ত করা, বিগত শূরার হাক্কানী আলেমদের পুনর্বহাল ও বিতর্কিত সদস্যদের পদচ্যুত করা।

“আল্লামা শফী পদত্যাগের পর আজ দিনভর মাদ্রাসার পরিস্থিতি শান্ত ছিল,” বিকেলে টেলিফোনে বেনারকে জানিয়েছিলেন ওই মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের শিক্ষার্থী রশিদ উল ইসলাম। তিনি বলেন, “হাটহাজারী মাদ্রাসা কেন্দ্রীয় মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজের পূর্বে বয়ান করেছেন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী।

বয়ানের সময় জুনায়েদ বলেছেন, শনিবার থেকে মাদরাসা খোলা থাকবে ও ক্লাস যথারীতি চলবে। তিনি সবাইকে যথারীতি ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পরামর্শ দিয়েছেন।

দেশে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার ভিত মজবুত করতে আহমদ শফী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশে দেওবন্দের অনুসারী আলেমদেরদের কাছে শতবর্ষী আহমদ শফী ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র, তাঁকে ডাকা হত ‘বড় হুজুর’ বলে।

কিন্তু হাটহাজারী মাদ্রাসা পরিচালনা, হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব ও রাজনীতি এবং কওমি মাদরাসা বোর্ড নিয়ে (বেফাক) দীর্ঘদিন ধরে অভ্যন্তরীণ সমস্যা চলছিল। এ নিয়ে আহমদ শফী ও সংগঠনটির মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে কিছু দিন বন্ধ ছিল। মাদ্রাসা খোলার পর বুধবার আকস্মিকভাবে মাদ্রাসার কয়েক শ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ শুরু করে। তারা শফীর অব্যাহতি এবং তার ছেলে আনাস মাদানীকে বহিষ্কারের দাবিতে বিভিন্ন কক্ষে ভাঙচুর চালায়।

এই পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার সরকার কওমি মাদ্রাসাটি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। এরপর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ওইদিন রাতে আহমদ শফীর নেতৃত্বে বৈঠকে বসে মাদ্রাসার শূরা কমিটি।

মাদ্রাসা প্রধান থেকে হেফাজত নেতা

আহমদ শফী ১৯১৬ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম ও ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় শিক্ষালাভ করেছেন তিনি। এরপর ১২৪ বছরের প্রাচীন আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলামে শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন।

১৯৮৯ সাল থেকে তিনি ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এবং মুহতারিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এর আগে ২০ বছরেরও বেশি সময় তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেছেন। মাদ্রাসাটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার।

ওই মাদ্রাসার প্রধান থাকার সুবাদেই তিনি হেফাজতের নেতৃত্ব পান এবং ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচীর মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ইসলাম ও নারী বিষয়ে তাঁর বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়।

ব্লগারদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে নানা বক্তব্য এবং পহেলা বৈশাখসহ বাঙালি সংস্কৃতির নানা দিক ও প্রগতির বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে তিনি সমালোচিত হয়েছেন বার বার।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পর তার বিরোধিতায় হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে মাঠে নেমে আহমদ শফী সারা দেশে পরিচিতি পান। ওই বছরের ৫ মে সরকার পতনের লক্ষ্যে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী পালন হয়। এরপর থেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও রাজনৈতিক নেতাদের তৎ​পরতায় সরকারের সঙ্গে হেফাজতের দূরত্ব কমতে থাকে।

গত জাতীয় নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকারের সঙ্গে সখ্য গড়ার মাধ্যমে তিনি কওমি মাদ্রাসা সনদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন দাবি আদায় করেন। হেফাজতের দাবি অনুযায়ী পাঠ্যবই থেকে প্রগতিশীল কিছু লেখকের কবিতা ও গল্প বাদ দেওয়া হয় এবং সরকারের বিরুদ্ধে এ নিয়ে কড়া সমালোচনা রয়েছে।

দেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের তিনিই প্রধান নেতা ছিলেন। আহমদ শফী কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশেরও (বেফাক) সভাপতি পদে ছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসের ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশের ১৩ হাজার ৯০২টি মাদ্রাসায় বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। কওমি মাদ্রাসার পক্ষ থেকে বলা হয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৭ লাখের কম নয়।

মাদ্রাসায় পরিবর্তন রাজনৈতিক

হাটহাজারি মাদ্রাসায় বিক্ষোভ এবং নেতৃত্বের পরিবর্তনকে রাজনৈতিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। মাদ্রাসাটির নেতৃত্বে যে পরিবর্তনের আন্দোলন হচ্ছে তাতে সেখানে সরকারপক্ষের অবস্থান দুর্বল এবং বিরোধী পক্ষ সবল হওয়ার সম্ভাবনা দেখেছেন তাঁরা। অবশেষে আহমেদ শফীর মৃত্যুর ফলে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব সরকার বিরোধীদের কবজায় যেতে পারে বলে তাঁরা মনে করেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ বেনারকে বলেন, “মাদ্রাসায় অসন্তোষ শুরু হয়েছিল তাদের অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয় নিয়ে। কিন্তু পরবর্তীতে তার সঙ্গে রাজনীতি যুক্ত হয়েছে।”

“অসন্তোষ আল্লামা শফীকে নিয়ে নয়, এটা গড়ে উঠেছে তার ছেলে আনাস মাদানীকে নিয়ে। আনাস মাদানীর সঙ্গে হেফাজতের মহাসচিব বাবুনগরীর দ্বন্দ্ব চলছিল, এই পরস্থিতি​ তারই ফলশ্রুতি।”

হাটহাজারী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ ভিন্ন দিকে গেলে হেফাজতের নেতৃত্বে নতুন ধারা তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন ইসলাম​ী এই চিন্তাবিদ। এর ফলে হেফাজতের পরবর্তী নেতৃত্ব সরকারের প্রতি মিত্র ভাবাপন্ন নাও হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।

ফরিদ উদ্দিন মাসুদ বলেন, “মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের প্রধান নেতা হয়ে গেলে এবং সেখানে আল্লামা শফীর পরিবারের কর্তৃত্ব শেষ হয়ে গেলে কওমি ধারার ইসলামিক আন্দোলনের দিক পরিবর্তন অসম্ভব নয়। জুনায়েদ বাবু নগরী মৌলিকভাবে বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দর্শনের মানুষ নন। কিন্তু তাদের নেতৃত্বের সামগ্রিক পরিমন্ডল কোন দিকে ঝুঁকবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে।”

ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে একজন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী হিসেবে জানিয়ে ফরিদ উদ্দিন বলেন, “কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা সাধারণত জামায়তে ইসলামীর অনুসারী হয় না। তবে নেতৃত্বের বিরোধ চলাকালে একটা অংশ জামায়াত-বিএনপির দিকে ঝুঁকতেও পারে।”

ওই মাদ্রাসায় নেতৃত্বের পরিবর্তন জাতীয় রাজনীতির ওপর প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ। তাঁর মতে, হাটহাজারী মাদ্রাসায় পরিকল্পিতভাবেই অস্থিতিশীলতা তৈরি করা হয়েছে এবং তাতে সরকার বিরোধী বিএনপি-জামায়তের হাত থাকতে পারে।

“একটি লুকায়িত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ওই মাদ্রাসার নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার জন্য আন্দোলন করা হচ্ছে,” বলেন তিনি।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে আব্দুর রশীদ বলেন, “সরকারের পতন ঘটানোর জন্যই ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামকে মাঠে নামানো হয়েছিল। সেই আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত সমর্থন দিয়েছিল। হাটহাজারী হলো হেফাজতের কেন্দ্রস্থল। যারা বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতে চান তাঁরা আহমেদ শফীসহ ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় যারা আছেন তাদের সহযোগিতা করছেন না। এ জন্যই সেখানে ছাত্রদের উস্কে দিয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি করা হয়েছে।”

আহমদ শ​ফীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে মরদেহ মাদ্রাসার ভেতরে অবস্থিত মসজিদের পাশে দাফন করা হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।