সাক্ষাৎকারে শারমিন: আমি চাই মেয়েরা যেন ভয় না পায়

জেসমিন পাপড়ি
2017.04.07
ঢাকা
আইডব্লিউওসি অ্যাওয়ার্ড ২০১৭ সম্মানে ভূষিত শারমিন আক্তার। আইডব্লিউওসি অ্যাওয়ার্ড ২০১৭ সম্মানে ভূষিত শারমিন আক্তার। ঢাকা, এপ্রিল ০৭, ২০১৭।
জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ

“সেসময় আমার ওপর এত অত্যাচার হচ্ছিল যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। মনে মনে ভাবলাম, সাহস নিয়ে কিছু একটা করে দেখি আমি বাল্য বিবাহের মতো অভিশাপ থেকে মুক্তি পাই কিনা।”

এভাবেই নিজের সংগ্রামের কথা বেনারকে জানালেন ঝালকাঠি জেলার রাজাপুরের কিশোরী শারমিন আক্তার।

প্রবাসী বাবার একমাত্র মেয়েকে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন তার মা। রাজি না হওয়ায় শারমিনের ওপর চলে নির্যাতন। পালিয়েও রেহাই না পেয়ে শেষে আইনের আশ্রয় নেন শারমিন। রোধ করেন নিজের বাল্য বিবাহ।

“আমি যখন নিজের বিয়েটা ঠেকিয়েছিলাম, তখন সেটা শুধু নিজের কথা ভেবেই করেছিলাম। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এখন বুঝতে পারি- আমি আসলে যা করেছি, তা দেশের সকল মেয়ের জন্যই করেছি,” বেনারকে বলেন শারমিন।

বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া বাংলাদেশের এই কিশোরীকে সেক্রেটারি অফ স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অফ কারেজ (আইডব্লিউওসি) অ্যাওয়ার্ড ২০১৭ সম্মানে ভূষিত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত ২৯ মার্চ ওয়াশিংটনে বিশ্বের আরো ১২ জন সাহসী নারীর সাথে শারমিনের হাতে এ পদক তুলে দেন মার্কিন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প।

বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) দেশে ফিরে শুক্রবার সন্ধ্যায় বেনারের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন শারমিন। কথোপকথনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অংশ:

বেনারের সাথে আলাপচারিতায় শারমিন আক্তার। ঢাকা, এপ্রিল ০৭, ২০১৭।
বেনারের সাথে আলাপচারিতায় শারমিন আক্তার। ঢাকা, এপ্রিল ০৭, ২০১৭।
[জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]
সাক্ষাৎকার

বেনারনিউজ: আইডব্লিউওসি পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি কী?

শারমিন আক্তার: আমি ভীষণ সম্মানিত বোধ করছি। এটি সত্যিই শুধু আমার জন্য নয়, দেশের সকল মেয়ের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রে আমি বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। সেগুলো থেকে নতুন করে স্বপ্ন দেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। ...ওই অনুষ্ঠানে আরো ১২টি দেশের ১২ জন নারীকে একই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তারাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহসিকতা দেখিয়েছেন। সেসব গল্প থেকেও অনুপ্রাণিত হয়েছি। যা আমার আগামী দিনের পথ চলার পাথেয় হয়ে থাকবে।

বেনার: যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডির হাত থেকে পুরস্কার নেবার সময় কেমন লাগছিল?

শারমিন: ওইদিন সবার আগে আমার হাতেই পুরস্কারটি দেওয়া হয়। ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প ভীষণ আন্তরিক ছিলেন। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানান। বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বানও জানান তিনি।

বেনার: আপনার নিজের গ্রামে বাল্য বিবাহের প্রকোপ কেমন?

শারমিন: আমাদের গ্রামে অনেক বাল্য বিবাহ হচ্ছে। আমি সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। অথচ আমার সহপাঠী অনেক মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। গ্রামে ১২ বছর বয়সী মেয়েদেরও বিয়ে দেওয়া হয়। …সবাই প্রশাসনের আশ্রয় নিতে পারে না। কিংবা প্রশাসনও সব সময় সমানভাবে এগিয়ে আসে না।

বেনার: বাল্য বিয়ের বিরুদ্ধে আপনার প্রতিবাদ দেখে গ্রামের অন্য মেয়েরা কতটুকু অনুপ্রাণিত?

শারমিন: সত্যি বলতে অনেক মেয়েই এখন সাহসী হয়ে উঠেছে। তাঁরা আমার উদাহরণ টেনে বলে- বাল্য বিয়ের প্রতিবাদ করে শারমিন কত দূর পর্যন্ত গেছে। আমরা যদি প্রতিবাদ করি, আমরাও এগিয়ে যেতে পারব। এটা শুনে সত্যি ভীষণ ভালো লাগে।

বেনার: এখন কি আপনি নিজ গ্রামের কিশোরীদের বিয়ে ঠেকাতে পারবেন বলে মনে করেন?

শারমিন: আমি মনে করি পারব। যেখানেই এ ধরনের ঘটনার কথা শুনব, সেখানে গিয়ে প্রতিবাদ করব। তারা যদি কথা না শোনে তাহলে আইনের আশ্রয় নেব।

বেনার: দেশের মেয়েদের জন্য কোনো বিশেষ বার্তা দিতে চান?

শারমিন: আমি চাই দেশে আর একটিও বাল্য বিবাহ না হোক। যারা এ ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছে, আমি চাই তারা আমার ব্যাপারটা দেখুক। তারা যেন ভয় না পায়। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখুক। তাহলে সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে। ...সাধারণত, মেয়েরা নিজেদের অসহায় ভাবে। সেটা না ভাবলে নিজেদের বাল্য বিবাহ নিজেরাই আটকাতে পারবে।

বেনার: বাংলাদেশে শর্তসাপেক্ষে বাল্য বিয়ের একটা আইন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

শারমিন: এই আইন সম্পর্কে শুনেছি, আদালতের মত থাকলে যেকোনো মেয়েকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে দিতে পারবে। আমি আইনটি নিয়ে কিছু বলব না। তবে কোনো মেয়ে যদি সে বিয়েতে রাজি না থাকে, তাহলে আমি তাকে সাহায্য করতে চাই।

বেনার: এখন আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

শারমিন: সবকিছুর আগে আমি নিজের পড়ালেখা শেষ করতে চাই। তবে সমাজে যে সব মেয়ে বাল্য বিবাহের শিকার হচ্ছে, তাদের পাশেও দাঁড়াতে চাই। আমি মনে করি আইনজীবী হলে আমি আরও বেশি করে বাল্য বিবাহ ঠেকানোর মতো কাজ করতে পারব। তাই আমি ভবিষ্যতে আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।