এবার চীন থেকে ছয়টি জাহাজ কিনছে বাংলাদেশ

জেসমিন পাপড়ি
2017.05.18
ঢাকা
বাংলাদেশ সফর শেষ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং- কে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ সফর শেষ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং- কে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অক্টোবর ১৫, ২০১৬।
স্টার মেইল

সাবমেরিনের পর এবার চীনের কাছ থেকে ছয়টি নতুন জাহাজ কিনছে বাংলাদেশ। একে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হওয়ার প্রমাণ বলছেন বিশ্লেষকেরা।

আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) বহরে এগুলো যুক্ত হবে বলে জানিয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বেনারকে বলেন, “আমাদের পররাষ্ট্র নীতিতে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষাপট অনেক গভীরে। দিনে দিনে এ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হচ্ছে।”

প্রসঙ্গত চীনের সাথে বাংলাদেশের সামরিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে বহুমাত্রিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে। ২০০২ সালে স্বাক্ষরিত ‘বাংলাদেশ-চীন ডিফেন্স কো-অপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট’ ছাড়াও বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনে তার মধ্যে চীন অন্যতম। সম্প্রতি এই তালিকায় যোগ হয়েছে ভারত।

এছাড়া গত বছরের ১৪-১৫ অক্টোবর চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে কর্ণফুলী নদীর বহুমুখী টানেল, খুলনা ও চট্টগ্রামে ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার এবং শাহজালাল সার কারখানা, উপকূলীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ অবকাঠামো উন্নয়ন ও সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

বেসামরিক উদ্দেশ্যে ছয়টি জাহাজ কেনার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব অশোক মাধব রায় বেনারকে বলেন, “বিএসসির পুরোনো বহরে ৩৬টি জাহাজ ছিল। সেগুলো অনেক পুরোনো হওয়ায় বিক্রি করতে করতে এখন মাত্র তিনটি রয়েছে। সমুদ্রে যাওয়ার মতো কোনো জাহাজ এখন বিএসসির বহরে নেই।”

“নতুন কেনা জাহাজগুলোর মাধ্যমে বিদেশ থেকে সরাসরি মালামাল আনা যাবে,” বলেন নৌ সচিব।

প্রসঙ্গত, এর আগে চীনে তৈরি দুটি কনভেনশনাল সাবমেরিনে কেনে বাংলাদেশ। গত বছরের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পৌঁছানো সাবমেরিন দুটি বানৌজা ‘নবযাত্রা’ ও বানৌজা ‘জয়যাত্রা’ নামে নৌ বাহিনীর বহরে যুক্ত হয়।

২০১৪ সালে সাবমেরিন দুটো কেনার জন্য চীনের সঙ্গে এক হাজার ৫৬৯ কোটি টাকার চুক্তি করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের মধ্যে চীনকে এ মূল্য পরিশোধ করা হবে।

তবে চীন থেকে সাবমেরিন কেনায় ভারতের কপালে ভাঁজ লক্ষ করেন সংশ্লিষ্টরা। ওই ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ সফর করেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর। পরে গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দেশটির সঙ্গে প্রতিরক্ষা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সম্প্রসারণের পাশাপাশি সামরিক সরঞ্জাম কিনতে বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ দানের ঘোষণা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

এটিকে বাংলাদেশের ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতির উদাহরণ উল্লেখ করে তারেক শামসুর রেহমান বেনারকে বলেন, “দেশের উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখাটা জরুরি। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশকে ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করতে দেখা যায়।”

অন্যদিকে ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা বিষয়ক এমওইউ স্বাক্ষরের ফলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারতের সাথে এক ধরনের বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে বলে মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন।

“আর এই ছয়টি জাহাজ বাণিজ্যিক কারণে কেনা হচ্ছে। এর সঙ্গে সামরিক সম্পৃক্ততা নেই। সে কারণেও ভারতের উদ্বেগ কম থাকবে,” বলেন এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চায়না ন্যাশনাল ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট মেশিনারিজ করপোরেশনের (সিএমসি) কাছ থেকে জাহাজগুলো কিনছে বাংলাদেশ। এগুলোর মধ্যে তিনটি অয়েল ট্যাংকার এবং তিনটি বাল্ক ক্যারিয়ার। প্রতিটি জাহাজের ধারণক্ষমতা ৩৯ হাজার ডেডওয়েট টন (ডিডব্লিউটি)।

ওয়েল ট্যাংকার দিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পরিশোধিত আমদানি করা তেল পরিবহন করা হবে। আর বাল্ক ক্যারিয়ারে খোলা পণ্য, সারসহ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা পরিবহন করা হবে বলে জানায় মন্ত্রণালয়।

জাহাজগুলো বর্তমানে চীনের জিয়াংশু প্রদেশের ওয়াইজেডজে শিপইয়ার্ডে নির্মাণাধীন রয়েছে। জাহাজগুলোর প্লেট কাটিং (কিল লেয়িং) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বর্তমানে চীন সফরে রয়েছেন নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

সিএমসি থেকে জাহাজ ছয়টি কিনতে ১ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে। তবে এর মধ্যে চীন সরকারের ঋণ থাকবে ১ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। বাকি ৩৯৫ কোটি টাকা দেবে বিএসসি।

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে যুক্ত করার জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে আরও ১৬টি জাহাজ কিনতে চীনের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে বাংলাদেশ।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই ১৬টি জাহাজের মধ্যে মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার ছয়টি এবং লাইটার বাল্ক ক্যারিয়ার ১০টি। নির্মাণ চুক্তির দুই বছরের মধ্যে এগুলো বাংলাদেশে পৌঁছাবে। জাহাজগুলো সরবরাহ করবে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড।

জানা যায়, নতুন কেনা এসব বাল্ক ক্যারিয়ার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা পরিবহনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে।

বিএসসির বহরে যুক্ত করতে প্রায় ১০ কোটি ডলারের আরও দুটি মাদার ট্যাংকার কিনতে ২০১৬ সালের এপ্রিলে চীনের চায়না পেট্রোলিয়াম টেকনোলজি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (সিপিটিডিসি) সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। প্রতিটি ট্যাংকারের ধারণ ক্ষমতা এক থেকে সোয়া লাখ টন।

চুক্তি অনুযায়ী এ ট্যাংকারগুলো আগামী বছর দেশে এসে পৌঁছানোর কথা। এই ট্যাংকারের মাধ্যমে আমদানি করা অপরিশোধিত তেল চট্টগ্রাম বহির্নোঙর পর্যন্ত পরিবহন করা যাবে।

বিএসসি সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে এমভি বাংলার দূত ও বাংলার সম্পদ নামে দুটি জাহাজ নিয়ে বিএসসির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৪ সালের মধ্যে বিএসসির বহরে যুক্ত হয় আরো ১৮টি জাহাজ।

এই জাহাজগুলো কোন দেশ থেকে আনা হয় সে বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে জানা যায়, ১৯৭৯-১৯৯১ সাল পর্যন্ত আরও ১৩টি জাহাজ কেনা হয় বিএসসির জন্য। এগুলোর মধ্যে জাপান থেকে চারটি, তৎকালীন ইস্ট জার্মানি থেকে দুটি, ডেনমার্ক থেকে দুইটি, চীন থেকে তিনটি এবং ফ্রান্স ও স্পেন থেকে একটি করে জাহাজ কেনা হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।