ভাঙার জন্য ইন্দোনেশিয়ার দূষিত জাহাজকে ঢুকতে দেবে না বাংলাদেশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.05.01
ঢাকা
200501-BD-toxic-ship-620.JPG পুরোনো একটি জাহাজকে বেঁধে তীরের কাছাকাছি আনার জন্য চট্টগ্রামের একটি জাহাজভাঙা কারখানার শ্রমিকরা দীর্ঘ স্টিলের দড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছেন জাহাজটির কাছে। ১৭ জুলাই ২০১৩।
[রয়টার্স]

ইন্দোনেশিয়া থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা পরিত্যাক্ত ও বিষাক্ত ‘জে ন্যাট’ নামের জাহাজটিকে ভাঙার জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না বলে শুক্রবার বেনারকে জানিয়েছেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশি জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকারকদের সংগঠনের সদস্যরা বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে পুরানো জাহাজ কিনে আনেন বলে বেনারকে জানান শিল্প মন্ত্রণালয়ের জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়া ডেস্কের উপ-সচিব মো. আবুল খায়ের।

“সরকারের আইন মেনে, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং পরিবেশ দূষণ না করে এসব জাহাজ ভাঙতে হয়,” জানিয়ে তিনি বলেন, “বিষাক্ত পদার্থ বহনকারী কোনো জাহাজ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবে না।”

‘জে ন্যাট’ জাহাজটিতে পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি থাকায় পরিবেশবাদীদের আপত্তি সত্ত্বেও গত ১৮ এপ্রিল এটি বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে ইন্দোনেশিয়া ছেড়ে আসে বলে বুধবার এক বিবৃতিতে জানায় বেলজিয়াম ভিত্তিক পরিবেশবাদী সংগঠন এনজিও শিপব্রেকিং প্লাটফর্ম।

“দাপ্তরিক নথিপত্র অনুযায়ী জাহাজটির ট্যাংকারে তেল উত্তোলন ক্ষেত্রের দেড় হাজার টনের বেশি দূষিত বর্জ্য রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে এক হাজার টন স্লপ ওয়েল, পাঁচশ টন তৈলাক্ত জল ও অতিমাত্রায় পারদমিশ্রিত ৬০ টন অয়েল স্লাজ,” বলা হয় বিবৃতিতে।

একই সাথে জাহাজটির কাঠামোতে ক্ষতিকর পারদের উপস্থিতি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে বলা হয়, জাহাজটি আগামী ৭ মে চট্টগ্রামে পৌঁছার কথা।

“আমরা সংবাদপত্রসহ বেসরকারি কয়েকটি সংগঠনের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে পুনঃপ্রক্রিয়াকারকদের সংগঠনের সদস্যদের জানিয়ে দিয়েছি যে, কোনোভাবেই জাহাজটিকে বাংলাদেশে আনা যাবে না,” বলেন আবুল খায়ের।

জাহাজটিকে বাংলাদেশে নোঙর করানোর আগে সংশ্লিষ্টদের মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তি নিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা এই জাহাজের জন্য অনাপত্তি দেবো না। এ কথা সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

এদিকে বাংলাদেশে কারা জাহাজটি আমদানি করছে তা জানা নেই বলে শুক্রবার বেনারকে জানান বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আবু তাহের।

তিনি বলেন, “জাহাজ আমদানি করতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি প্রয়োজন হয়। গত দেড়মাস ধরে শিল্প মন্ত্রণালয় বন্ধ। সুতরাং, আমরা জানি না কারা জাহাজটি আমদানি করছে।”

“সরকারের পক্ষ থেকে জাহাজটি বাংলাদেশে আনতে নিষেধ করার পর আমরা আমাদের সকল সদস্যদের বলেছি তারা যেন জাহাজটি আমদানি না করে,” বলেন আবু তাহের।

এনজিও শিপব্রেকিং প্লাটফর্ম এর তথ্য অনুসারে, জে ন্যাট জাহাজটির আগের নাম ছিল জেসলিন নতুনা। তেলবাহী জাহাজটি আগে ইন্দোনেশিয়ার নতুনা গ্যাস ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো।

কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলার পর জাহাজটির ইন্দোনেশিয়ান মালিক গ্লোবাল নিয়াগা বেরসামা সম্প্রতি এটিকে সোম্যাপ ইন্টারন্যাশনাল নামে পুরোনো জাহাজ ব্যবসায়ী এক কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়। তারা জাহাজটির নাম পরিবর্তন করে 'জে ন্যাট' নামকরণ করে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বেনারকে বলেন, “জাহাজ ভাঙার কারণে দূষিত রাসায়নিক পদার্থ বাংলাদেশের পরিবেশের ক্ষতি করছে। শ্রমিকদের যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করায় প্রতিবছর অনেক শ্রমিক জাহাজ ভাঙতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন।”

জে নেট নামের জাহাজটি যাতে কোনোভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ না করতে পারে, সেজন্য পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁরা রোববার পরিবেশ মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাবেন বলেও জানান রিজওয়ানা হাসান।

এদিকে নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) শুক্রবার এক বিবৃতিতে জে ন্যাট ওয়েল ট্যাঙ্কারটির বাংলাদেশে আগমনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

সংগঠনের সভাপতি হাফিজ উদ্দিন খান ও সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, বিষাক্ত এই জাহাজ যেন বাংলাদেশে কোনোভাবেই ঢুকতে না পারে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি তাঁরা আহ্বান জানান।

বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্প

বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকারক দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্প মূলত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড কেন্দ্রীক। আয়ু শেষ হয়ে যাওয়া বিভিন্ন দেশের জাহাজ বাংলাদেশে এনে সেখানে কাটা হয়।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ লোহা ও স্টিলের চাহিদা মূলত জাহাজভাঙা শিল্প থেকে আসে। সরকার জাহাজভাঙাকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর অংশ হিসেবে বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলায় জাহাজভাঙা শিল্প কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক জাহাজ ভাঙা হয়েছে বাংলাদেশে। ওই বছর আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাংলাদেশ ২৩৬টি জাহাজ ভাঙার জন্য আমদানি করে।

গত অক্টোবরে প্রকাশিত জাতিসংঘের উন্নয়ন ও বাণিজ্য সংস্থা ‘আঙ্কটাড’ এর ‘রিভিউ অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট ২০১৯’ অনুযায়ী ২০১৮ সালে বিশ্বে যত জাহাজ ভাঙা হয়েছে, তার ৪৭ শতাংশই ভাঙা হয়েছে বাংলাদেশে।

জাহাজ ভাঙায় বিশ্বে সর্বোচ্চ স্থান নিয়ে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ৮৬ লাখ টন আয়তনের জাহাজ ভেঙেছে। ওই বছর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারতে ভাঙা হয়েছে ৪৬ লাখ ৯০ হাজার টন আয়তনের জাহাজ। ২০১৭ সালে জাহাজ ভাঙায় শীর্ষ স্থানে ছিল ভারত।

শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ১৯৬টি জাহাজ ভেঙে পাওয়া গেছে ২৫ লাখ ৮১ হাজার টন লোহা।

সরকারি হিসেবে, চট্টগ্রামের উত্তর উপকূলে প্রায় ১২০টি জাহাজ ভাঙার কারখানা রয়েছে। প্রতি বছর এই সংখ্যা বেড়েই চলছে। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সরাসরি এই শিল্পের সাথে জড়িত।

তবে অধিকাংশ পুরানো জাহাজে মানবদেহের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর পারদ, সীসাসহ নানা ধরনের দূষিত পদার্থ থাকে। অধিকাংশ সময় বিষাক্ত পদার্থগুলো সঠিকভাবে পরিষ্কার করা হয় না বলে অভিযোগ পরিবেশবাদীদের। ফলে সাগর ও আশেপাশের এলাকায় মারাত্মক দূষণ তৈরি হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।