বাংলাদেশে গরু পাচারের অভিযোগে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী কর্মকর্তা গ্রেপ্তার
2020.11.17
কলকাতা
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে গরু পাচার চক্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর কর্মকর্তা সতীশ কুমারকে গ্রেপ্তার করেছে। কমান্ড্যান্ট পদমর্যাদার ওই কর্মকর্তাকে মঙ্গলবার কলকাতায় দীর্ঘ সাত ঘন্টা জেরার পর গ্রেপ্তার দেখায় সিবিআই।
ভারতের জাতীয় সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া সিবিআই সূত্রের বরাত দিয়ে বিএসএফ কমান্ডান্টের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর নিশ্চিত করে। বুধবার সতীশ কুমারকে কলকাতার সিবিআই আদালতে হাজির করা হবে।
সতীশ কুমার ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৩৬ ব্যাটালিয়নের কমান্ডান্ট হিসেবে মালদহে নিযুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ছত্তিশগড়ের রায়পুরে কর্মরত। তদন্তকালে গোয়েন্দারা সতীশ কুমারের মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির খোঁজ পেয়েছেন।
সীমান্ত অঞ্চলে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলার মানবিধকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সম্পাদক কিরীটি রায় বেনারকে বলেন, “সতীশ কুমারের গ্রেপ্তারের ফলে আমাদের দীর্ঘদিনের অভিযোগই সত্য প্রমাণিত হলো। আমরা বারবার বলে এসেছি, বিএসএফ, শুল্ক বিভাগ ও পুলিশ পাচারের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এদের সহায়তা ছাড়া সীমান্ত দিয়ে পাচার সম্ভব নয়।”
লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা ও মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরীও এদিনের গ্রেপ্তারের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের বলেন, “শুধু বিএসএফই নয়, সীমান্তে পাচারের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলা প্রশাসনের উচ্চ আধিকারিক থেকে শাসক দলের নেতারা পর্যন্ত জড়িত। প্রকৃত তদন্ত হলে বহু গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটবে,” মনে করেন তিনি।
গরু পাচারের চক্র
গরু পাচার সংক্রান্ত একটি পুরানো মামলার তদন্তের সূত্রে সীমান্ত দিয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ), কেন্দ্রীয় শুল্ক (কাস্টমস) বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরের একাধিক সরকারি আধিকারিকের যুক্ত থাকার নানা তথ্য হাতে পায় সিবিআই।
এরপর গত ২ নভেম্বর বিএসএফ কমান্ড্যান্ট সতীশ কুমার এবং ব্যবসায়ী মুহাম্মদ এনামুল হক, আনারুল শেখ ও মহম্মদ গোলাম মোস্তাফার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সিবিআই।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গ ও অন্য কয়েকটি রাজ্যের ১৫টি শহরে বিএসএফ আধিকারিক, শুল্ক বিভাগের অফিসার ও গরু পাচারকারীদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সিবিআই প্রচুর তথ্যপ্রমাণ জব্দ করে।
গত ৬ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় ব্যবসায়ী এনামুল হককে। তদন্তকারীদের তথ্য মতে, গরু পাচারচক্রের প্রধান হোতা এই এনামুল হক। তাঁর তত্ত্বাবধানেই বাংলাদেশে গরু পাচার হতো। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন।
সিবিআই এফআইআরে উল্লেখ করেছে, সতীশ কুমার মালদহে কমান্ড্যান্ট থাকাকালীন ১৬ মাসে মালদহ ও মুর্শিদাবাদ দিয়ে বাংলাদেশে পাচারের সময় প্রায় ২০ হাজার গরু ধরা পড়ে, কিন্তু একজন পাচারকারীকেও গ্রেপ্তার করা হয়নি। এমনকি তারা যেসব পরিবহন ব্যবহার করে গরু নিয়ে আসত, সেগুলিকেও বাজেয়াপ্ত করা হয়নি।
সিবিআইয়ের আরও অভিযোগ, বাজেয়াপ্ত করা গরু ২৪ ঘন্টার মধ্যেই মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুরের শুল্ক কার্যালয় থেকে নিলাম করা হতো। সরকারি খাতায় গরুকে বাছুর হিসেবে দেখিয়ে কম দামে স্থানীয় বাজারে নিলাম করা হতো। সেখান থেকে বাছুরের দামে গরু কিনে নিত পাচারকারীরা।
এই সহযোগিতার বিনিময়ে পাচারকারীরা প্রতিটি গরুর জন্য ২৫ ডলার বিএসএফ কর্মকর্তা ও এক ডলার করে শুল্ক কর্মকর্তাদের দিত। নিয়মিত উপঢৌকনের অতিরিক্ত ছিল এই অর্থ।
পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব, রাজস্থান, বিহার, ওড়িশা ও ছত্তিশগড় খেকে দুশ ডলারে গরু কিনে সেগুলো সাড়ে তিনশ ডলারে পাচার করা হতো বাংলাদেশে।
কিরীটি রায় বলেন, “ভারত ও বাংলাদেশের পশ্চিমবঙ্গ অংশের দু হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমান্তের অরক্ষিত অঞ্চল দিয়ে গরু পাচার থেকে শুরু করে, নারী, সোনা ও মাদক বাণিজ্য চলে খোলাখুলিভাবে।”
গরু পাচার অনেকটা কমলেও এখনও তা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিএসএফের সাবেক ডিআইজি এস কে মিত্র বলেন, “সীমান্তে এখন নজরদারি অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে সংগঠিতভাবে এখন গরু পাচার হচ্ছে বলে মনে হয় না।”
তিনি বলেন, “সীমান্তে পাচারের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীরা শাস্তি পাক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, উত্তর ভারতের রাজ্যগুলো থেকে গরু সীমান্তে নিয়ে আসা হচ্ছে কীভাবে? সুতরাং তদন্তের পরিধি অন্য রাজ্যগুলোতেও প্রসারিত করে জানা দরকার কারা কারা এর সঙ্গে যুক্ত।”
ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বেনারকে বলেন, “আমরা আনেকদিন ধরে গরু পাচার বন্ধের দাবি জানাচ্ছি। তবে গরু পাচারের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ ও শাসক দলের রাজনৈতিক নেতাদেরও খুঁজে বের করা দরকার।”
পাচারের নৃশংসতা
উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা শ্যামল মন্ডল বেনারকে গরু পাচারের নৃশংসতা তুলে ধরে বলেন, গরুকে ট্রাকের মধ্যে মুখ বেঁধে সবজির নিচে চাপা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সীমান্তের কাছাকাছি।
তারপর এদের পাগুলো দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়। বাঁধা হয় মুখ ও চোখ। এর পরে রাতের অন্ধকারে কলাগাছের সঙ্গে বেঁধে গরুগুলো নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
মালদহের আদাডাঙ্গার বাসিন্দা শেখ শাহাজার বেনারকে জানান, “সীমান্ত অঞ্চলের গরিব মানুষকে অর্থের প্রলোভনে পাচারে যুক্ত করা হয়। গরু পাচার করলে ভালো অর্থ পাওয়া যায়। তবে বিএসএফের গুলিতে এই গরিবেরাই মারা পড়ে। কিন্তু পাচার চক্রের মূল হোতাদের কখনোই ধরা হয় না।”