মেক্সিকোর জেলখানায় দুই শতাধিক বাংলাদেশি, গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র
2021.11.30
ঢাকা

অবৈধভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় আটক হয়ে মেক্সিকোর কারাগারে রয়েছেন কমপক্ষে ২৩০ বাংলাদেশি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এই তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে মেক্সিকো সিটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস।
পররাষ্ট্র সচিবের কাছে লেখা ওই চিঠির একটি অনুলিপি বেনারের হাতে রয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী এবং কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মূলত অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারকারীদের সহায়তায় অবৈধভাবে তরুণরা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও এই প্রবণতা বন্ধে তেমন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ তাঁদের।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “কিছু ডেসপারেট মানুষ থাকে যারা বিদেশ যাওয়ার জন্য অবৈধ পথ বেছে নেয়। তারা ইউরোপ-আমেরিকা এসব দেশে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখে।”
তাঁর মতে, “বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার আগের চেয়ে কমেছে বলে আমি মনে করি।”
“আমরা মানবপাচার বন্ধ করতে ইমিগ্রেশনকে কঠোর করেছি। ই-পাসপোর্ট চালু করেছি। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে মানবপাচার কমে আসবে। আমরা এগুলো বন্ধ করব,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
উল্লেখ্য, লিবিয়া হয়ে অবৈধভাবে ইউরোপের উন্নত দেশে প্রবেশের চেষ্টা বেশ আলোচিত। কিন্তু মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে মানবপাচারকারীদের সহায়তায় বাংলাদেশি নাগরিকেরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টার ঘটনা খুব একটা শোনা যায় না।
“বাংলাদেশ থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করার ঘটনা নতুন নয়। তবে মেক্সিকো হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের প্রবণতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃদ্ধি পেয়েছে,” বেনারকে বলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতারা মঙ্গলবার বেনারকে জানান, “মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশিদের প্রবেশের ঘটনা আগেও ছিল, তবে সাম্প্রতিক করোনা মহামারির সময়ে তা বেড়েছে।”
অভিবাসন বিভাগের সম্ভাব্য জেরা এড়াতে তাঁরা পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।
প্রসঙ্গত, মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানবপাচারের দায়ে চলতি বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশি নাগরিক মো. মিলন হোসেন এবং এর আগে জানুয়ারিতে মিলনের সহযোগী মোক্তার হোসেনকে ৪৬ মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত।
কয়েক মাসে, অনেক দেশ ঘুরে সীমান্তে
মেক্সিকো দূতাবাসের ওই চিঠিতে বলা হয়, যারা মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশকারীদের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, তবে বাংলাদেশিদের সংখ্যাও “উল্লেখযোগ্য”।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশের মানবপাচারকারীরা দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণদের “মোটা অর্থের বিনিময়ে এই অনিশ্চিত এবং বিপজ্জনক যাত্রায় প্রলুব্ধ করে চলেছে।”
চিঠির বিবরণ মতে, ২০২০ সালে মেক্সিকোর বিভিন্ন কারাগারে আটক ৬০০ বাংলাদেশির সাক্ষাতকার গ্রহণ করে বাংলাদেশ দূতাবাস। তাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, এদের মধ্যে একজন বাদে সবাই পুরুষ। প্রত্যেকে ১৫ থেকে ২২ লাখ টাকা পাচারকারীদের দেবার কথা জানিয়েছেন।
“অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশীদের ৯০ শতাংশের বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলায়,” চিঠিতে বলা হয়।
ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালে ৪২১, ২০১৮ সালে ৬৩১, ২০১৯ সালে ৪২১ এবং ২০২০ ও ২০২১ (জানুয়ারি থেকে আগস্ট) সালে ২৩০ করে ৪৬০ জন অবৈধ বাংলাদেশি মেক্সিকোতে অবস্থান করছিলেন।
এই অভিবাসীরা প্রথমে সড়কপথে বৈধভাবে ঢাকা থেকে কলকাতা ও দিল্লী গিয়ে তাঁদের যাত্রা শুরু করেন বলে জানানো হয় ওই চিঠিতে।
এতে বলা হয়, নয়াদিল্লী থেকে অভিবাসীরা “কোনো ভিসা ছাড়াই” ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সেযোগে দুবাই ও আদ্দিস আবাবা হয়ে ব্রাজিলের সাও পাওলো (ব্রাজিল) পৌঁছান। “এরপর তারা বিমানপথে পেরুতে গমন করে।”
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মেক্সিকোর সীমান্তবর্তী এলাকায় পৌঁছানোর আগে অভিবাসীরা বাস, নৌকা এবং পায়ে হেঁটে আট দেশ তথা ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, এল সালভেদর, হন্ডুরাস এবং গুয়াতেমালা অতিক্রম করেন বলে জানানো হয় দূতাবাসের ওই চিঠিতে।
এতে বলা হয়, ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স, নয়াদিল্লী, দুবাই, আদ্দিস আবাবা এবং সাওপাওলোর ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা এই মানবপাচার চক্রের সাথে জড়িত।
“ঢাকা থেকে মেক্সিকো যেতে তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগে এবং পথিমধ্যে তাদের পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে। মেক্সিকো পৌঁছার পর তারা নিজেদের রাষ্ট্রহীন হিসাবে মেক্সিকো পুলিশের কাছে ধরা দেয়,” উল্লেখ করেছে দূতাবাস।
কারণ ‘অর্থনৈতিক বৈষম্য’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কনভেনশনের সদস্য হওয়ায় কোনো রাষ্ট্রহীন মানুষকে একটানা ৪০ দিনের বেশি কারারুদ্ধ রাখতে পারে না মেক্সিকো সরকার। তারা সেখানে “রাষ্ট্রহীন অভিবাসী” ইমিগ্রেশন পাশ লাভ করে এবং সীমান্ত দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে।
চিঠিতে বলা হয়, এই সকল অভিবাসীরা দূতাবাস কর্মকর্তাদের জানান, তারা মৃত্যুবরণ করলেও দেশে ফেরত যাবে না।
অভিবাসীরা নিজেদের বিরোধী লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সদস্য দাবি করে বাংলাদেশ ত্যাগের কারণ হিসাবে দেশে “সংকুচিত রাজনৈতিক” অবস্থাকে দায়ী করেছেন বলে জানানো হয় চিঠিতে।
তবে কেউই এলডিপি প্রধান কর্নেল অলি আহমদ ছাড়া আর কোনো স্থানীয় নেতার নাম বলতে পারেননি বলে জানানো হয় চিঠিতে।
এদিকে এলডিপির প্রেসিডেন্ট অলি আহমদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমার দলের নেতা-কর্মীরা এভাবে অবৈধভাবে মেক্সিকো যাচ্ছে, এমনটি আমার জানা নেই। আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম।”
তিনি বলেন, “মানবপাচারকারীরা আমার দলের নাম ব্যবহার করছে, কারণ হয়তো অন্য সব রাজনৈতিক দল পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে বিতর্কিত হয়েছে।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির মঙ্গলবার বেনারকে জানান, তিনি যখন (২০০৬) যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন তখন খুব অল্প সংখ্যক বাংলাদেশি মেক্সিকো হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করার চেষ্টা করতেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে প্রতি বছর ২০ লাখ মানুষ নতুন করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। সবাই কিন্তু চাকরি পাচ্ছে না। সেকারণে তারা যে, যেভাবে পারছে ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করে যাচ্ছে।”
“এগুলো রাতারাতি বন্ধ করা যাবে না,” মন্তব্য করে হুমায়ূন কবির বলেন, “যতক্ষণ না আমরা আমাদের জনগোষ্ঠীকে চাকুরি অথবা কাজের সুযোগ দিতে না পারব, ততদিন এটি বন্ধ হবে না।”
মেক্সিকো হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের প্রবণতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়ে যাবার মূল কারণ “অর্থনৈতিক বৈষম্য,” বলে মন্তব্য করেন নূর খান।
“বাংলাদেশে বড়ো বড়ো উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে। তবে সাধারণ মানুষ এর সুফল পাচ্ছে খুব কমই। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে টাকা চলে যাচ্ছে। আর সেকারণেই মানুষ ভালো ভবিষ্যতের আশায় জীবনকে হুমকির মখে ফেলে মানবপাচারকারীদের সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। অনেকে পথিমধ্যে প্রাণও হারাচ্ছে,” বলেন তিনি।
এই প্রবণতা বন্ধে “সরকারও খুব বেশি কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে মনে হয় না,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হলো বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা।”
“করোনাভাইরাস মহামারির কারণে লাখ লাখ মানুষ চাকরি ও ব্যবসা হারিয়েছে। তাই এসব মানুষ উন্নত জীবনের আশায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে,” বলেন তিনি।
তাঁর মতে, মেক্সিকো সীমান্ত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশকালে ২৪০ জন ধরা পড়ার সংখ্যাটি “অনেক বেশি বলতে হবে।”
“এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মানবপাচার সম্পর্কিত বার্ষিক ট্র্যাফিকিং ইন পারসন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থার অবনমন করে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে পড়ে যাবে। তাই এখনই এ বিষয়ে সাবধান হওয়া দরকার,” বলেন নূর খান।