শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ক্ষতির অজুহাতে রাতে ৬ ঘণ্টা ফেসবুক বন্ধের চিন্তা সরকারে

পুলক ঘটক
2017.04.03
ঢাকা
ফেসবুক খুলে দেওয়ার দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধন। ফেসবুক খুলে দেওয়ার দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধন। ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৬।
স্টার মেইল

প্রতিদিন মধ্যরাত থেকে টানা ছয় ঘণ্টা ফেসবুক বন্ধ রাখার কথা ভাবছে বাংলাদেশ সরকার। তবে এখনো এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

শিক্ষার্থী ও তরুণদের 'মঙ্গলের জন্য' রাতে ফেসবুক বন্ধ রাখার এই উদ্যোগের কথা জানিয়ে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন শাখা।

গত বছর জেলা প্রশাসক সম্মেলনে আসা একটি প্রস্তাবের ভিত্তিতে ২৭ মার্চ ওই চিঠি পাঠানো হয় বলে জানিয়েছেন টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব শ্যাম সুন্দর শিকদার।

চিঠিতে বলা হয়েছে, “ফেসবুক আসক্তির কারণে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে। তরুণদের কর্মক্ষমতায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে।”

শ্যাম সুন্দর বেনারকে বলেন, “চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির মতামত চাওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সময় নির্দিষ্টকরণের বিষয়ে বিটিআরসি’র মতামত দরকার।”

তবে বিটিআরসি চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বেনারকে বলেছেন, “চিঠিটি আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি। চিঠিতে উল্লেখিত ওই সময়ে ছাত্রছাত্রী ও শিশুরা ফেসবুক ব্যবহার করে না।”

তিনি বলেন, “ওই সময় ফেসবুক বন্ধ রাখালে উপকার হবে বলে মনে হয় না। আমরা আজই চিঠির মাধ্যমে আমাদের মতামত কেবিনেট ডিভিশনকে জানিয়ে দেবো।”

সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে ফেসবুক ব‌্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। আর বিশ্বে এই সংখ্যা ১৭৯ কোটির বেশি, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ।

উপর্যুপরি ব্লগার, বিভিন্ন ধর্মের যাজক ও বিদেশি নাগরিকদের হত্যার ঘটনা ঘটায় ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে টানা ২২ দিন বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ রেখেছিল সরকার। পাশাপাশি বন্ধ রাখা হয় ভাইবার, ম্যাসেঞ্জার, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপসহ অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমও।

কেন এই নিয়ন্ত্রণ?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উগ্রপন্থী বিভিন্ন সংগঠন কর্মী সংগ্রহ, মতবাদ প্রচার ও গোপনে সংগঠিত হওয়ার কাজ করছে বলে সরকারের মন্ত্রীরা একাধিকবার অভিযোগ করেছেন। একই প্রেক্ষাপটে আগেও কয়েক দফা ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল সরকার।

সরকারের নীতি নির্ধারকদের অভিযোগ, বিদেশ থেকে ফেসবুকে বেনামি আইডি ব্যবহার করে জঙ্গিবাদ ছড়ানো হচ্ছে। এসব ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে সমস্যা হচ্ছে।

তবে সমালোচকদের মতে, ফেসবুকে সাধারণ মানুষ খোলামেলাভাবে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাদের “গলার কাঁটা” হয়ে উঠেছে।

“কর্তাদের দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনাসহ সব ধরনের অগণতান্ত্রিক আচরণের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের বড় মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। এখানে মানুষ মতামত প্রকাশের পাশাপাশি অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সরকার এটা সহ্য করতে পারছে না,” বেনারকে বলেন মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

সম্প্রতি ফেসবুকের মাধ্যমে এসএসসি-এইচএসসিসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার প্রমাণও মিলেছে, যা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে।

তবে এসব কোনো কারণকে এড়িয়ে ছাত্রছাত্রীরা যাতে পড়াশোনার পরিবর্তে রাত জেগে ফেসবুকে সময় না কাটায় সে জন্য এই নিয়ন্ত্রণের চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সরকার।

তবে ফেসবুক নিয়ন্ত্রণে সরকারের ইচ্ছাকে মানতে পারছেন না ব্যবহারকারীরা। এ প্রসঙ্গে লালমাটিয়া হাউজিং স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আকমল হোসেন বেনারকে বলেছেন, “ফেসবুকে আমরা মতামত, অভিব্যক্তি এবং আনন্দ-বেদনার কথা লিখি। আনন্দ ভাগাভাগি করার এ সুযোগ সংকুচিত করা উচিত নয়।”

ফেসবুকের সঙ্গে সরকারের দেন দরবার

ফেসবুক বাংলাদেশে কী ধরনের সমস্যা তৈরি করছে তা জানিয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উগ্রবাদ প্রচার ও সাইবার নিরাপত্তার প্রশ্নে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে সরকার।

কিছু আইডি’র তথ্য চেয়েও না পাওয়ায় নভেম্বর মাসে সরকার ফেসবুক বন্ধ করে দিলে ফেসবুকের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে সরকারের তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে।

গত বছরের জানুয়ারিতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে ফেসবুকের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান কার্যালয়ে বৈঠকও করেন সরকারের মন্ত্রীরা।

এসব বৈঠকের পর জানানো হয়, বাংলাদেশ সরকারের চাওয়া অনুযায়ী, উগ্রবাদ ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যবহারকারীর তথ্য সরকারকে সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।

ইন্টারনেটে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়’ নিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিকার পাওয়ার জন্য ফেসবুকের পাশাপাশি গুগল ও মাইক্রোসফটের সঙ্গেও সরকারের ‘সমঝোতা’ হয়েছে বলে গত জুনে জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে জানিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।

গত ৩ মার্চ এক অনুষ্ঠানে তারানা বলেছেন, “ফেসবুক তাদের কথামত আপত্তি উত্থাপনের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাড়া দিচ্ছে। উসকানিমূলক, জঙ্গিবাদ ছড়ায়-এ ধরনের পেজ তারা বন্ধ করেছেন।”

চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে মোট ১০টি অনুরোধের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নয়জন ব্যবহারকারীর তথ্য চাওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ২০ শতাংশ তথ্য সরকারকে দিয়েছে বলে ফেসবুকের ‘গভর্নমেন্ট রিকোয়েস্ট রিপোর্ট’ এ বলা হয়েছে।

তবে বরাবরের মতোই সংশ্লিষ্ট ব্যবহারকারীর নাম বা কনটেন্ট সম্পর্কে কোনো তথ্য ফেসবুকের প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়নি।

আপত্তিকর কনটেন্টের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে শিগগিরই ফেসবুকের সঙ্গে আবারও আলোচনায় বসবেন বলে জানান তারানা হালিম।

এর আগে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত আড়াই বছরে ৩৭ জন ব্যবহারকারীর তথ্য ফেসবুকের কাছে চাওয়া হলেও সাড়া পায়নি সরকার।

মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি

গতকাল সন্ধ্যায় সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, “গণমাধ্যমে প্রচারিত ফেসবুক বন্ধের সংবাদটি সঠিক নয়। সরকার ফেসবুক বন্ধ করতে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি।”

তবে সরকারি সংবাদ সংস্থা বিএসএস এর এক খবরে বলা হয়েছে, ছাত্রছাত্রী ও তরুণদের ফেসবুক ব্যবহারের বিষয়ে কিছু স্বনিয়ন্ত্রণমূলক সুপারিশ প্রদান করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। সংস্থাটি বলেছে, ফেসবুকে সিকিউরিটি ও প্রাইভেসি ফিচারগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, সচেতনতামূলক প্রচারণা এবং অভিভাবকদের নজরদারি দরকার।

অল্প বয়স্কদের জন্য তাদের অভিভাবকেরা যেন ফেসবুকে আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে তার সুপারিশ করা হয়েছে।

কেবিনেট ডিভিশনের চিঠির জবাবে বিটিআরসি বলেছে, “রাতের ৬ ঘণ্টা ফেসবুক বন্ধ রাখার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা কৌশলগত দিক থেকে একটি কঠিন কাজ। শুধু ছাত্রদের জন্য এই ব্যবস্থা চালুর মতো কোনো কার্যকর পন্থা আপাতত নেই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।