শেয়ারবাজারের অব্যাহত দরপতন ঠেকাতে ফের নিয়ন্ত্রণ আরোপ
2024.04.24
ঢাকা
প্রায় তিন মাস ধরে চলমান পতন ঠেকাতে নতুন করে দরপতনের ক্ষেত্রে সীমা আরোপ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বুধবার বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়, “এখন থেকে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের দাম এক দিনে তিন শতাংশের বেশি কমতে পারবে না।”
বর্তমানে দাম ভেদে কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত দরপতন হতে পারে।
এছাড়া ওই আদেশ অনুযায়ী, প্রতিদিনের লেনদেনে শেয়ারের দাম সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারবে; এটি শেয়ারবাজারে সার্কিট ব্রেকার হিসেবে পরিচিত।
নতুন এ আদেশ বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হবে।
শেয়ারবাজারের দরপতন ঠেকাতে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ।
ফ্লোর প্রাইস হলো, একটি নির্ধারিত দরের নিচে শেয়ারের দর নামবে না।
তবে সমালোচনার মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার গঠনের এক সপ্তাহ পর গত ১৯ জানুয়ারি ওই নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল বাজার যাতে নিজের শক্তিতে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। কিন্তু তা না হয়ে ক্রমাগত কমছিল।
ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার পর গত তিন মাসের বেশি সময়ে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মূল সূচক ৭৬০ পয়েন্ট কমেছে, যা প্রায় ১২ শতাংশ। এই সময়ে বাজার মূলধন হারিয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকার উপরে।
এমন পরিস্থিতির জন্য বাজারে কারসাজি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সুশাসনের অভাব ও আস্থা কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন বিনিয়োগকারীরা।
ফলে বিনিয়োগের তুলনায় লোকসান দিয়ে হলেও টাকা তুলে নেওয়া যৌক্তিক মনে করেছেন অনেকে, যা দরপতন তরান্বিত করেছে।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর মতিঝিলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করে বাজার স্থিতিশীলতায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এক সপ্তাহের সময় বেঁধে দেয়। দাবি পূরণ না হলে আগামী মঙ্গলবার থেকে ফের আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।
‘নিয়ন্ত্রণ আরোপ সুফল আসবে না’
ফ্লোর প্রাইসের সঙ্গে এই সার্কিট ব্রেকারের পার্থক্য হলো, এতে পতন হবে, তবে ধীরে ধীরে।
বিনিয়োগকারী ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নিয়ন্ত্রণ আরোপ বাজারে স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে যৌক্তিক পদক্ষেপ না।
পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশিদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “এ পদ্ধতিতে বাজারে পতন ঠেকানো সম্ভব হবে না।”
তিনি বলেন, “এতে প্রতিদিন তিন শতাংশ করে দরপতনের অনুমোদন আছে, অর্থাৎ তিন দিনে ১০০ টাকার শেয়ারের দর নয় টাকা কমে যাবে। তাহলে এটি দরপতন ঠেকানো টেকসই পদ্ধতি হলো কীভাবে?”
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বেনারকে বলেন, “এর মাধ্যমে বাজারে দরপতন ঠেকানো সম্ভব হবে না। এটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ নয়।”
বাজারকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “শেয়ারবাজারে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপের উদাহরণ পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। বিদেশিরা (বিনিয়োগকারী) এসব দেখে হাসেন এবং এ জন্যই তারা বাজারে আসতে আগ্রহী হন না। বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট দূর করতে প্রথম কাজ হলো কর্পোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।”
অনিয়ম বন্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা পদক্ষেপ নিলে বাজার এমনিতেই তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পাবে বলে মত দেন তিনি।
অনিয়মকারীদের শাস্তি দাবি
বাজারে অনিয়মকারীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
মিজানুর রশিদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “যারা ২০১০ সাল থেকে বাজারে কারসাজি করেছে, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হোক। খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনে যাঁদের নাম উঠে এসেছে, কারসাজির দায়ে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।”
প্রসঙ্গত, পুঁজিবাজারে অনিয়ম নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। তবে এর ভিত্তিতে বড় ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার তথ্য জানা যায়নি।
মিজানুর রশিদ চৌধুরী বলেন, “বাজারে কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। এছাড়া মার্চেন্ট ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের সম্পদের হিসাব নেওয়া হোক। দুদকের মাধ্যমে আইনগত শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক (মুখপাত্র) মোহাম্মদ রেজাউল করিম বেনারকে বলেন, “যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম প্রমাণ হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
৩ মাসে শূন্য ৬১ হাজার বিও অ্যাকাউন্ট
পুঁজিবাজারের হিসাব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বিক্রি বাড়তে থাকায় গত তিন মাসে প্রায় ৬১ হাজার বেনিফিশিয়ারি ওনার বা বিও হিসাব শূন্য হয়ে গেছে। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে এসব হিসাবে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে শূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৬৩ হাজারে।
এছাড়া সর্বশেষ বুধবারও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক কমেছে ৫৬ পয়েন্ট। ফলে বড় বিপদে পড়েছে অপেক্ষাকৃত ছোট অংকের বিনিয়োগকারীরা।
আনোয়ার হোসেন রুবেল নামে একজন বিনিয়োগকারী বলেন, “গত ১০ বছর যাবত বাজারে লোকসান দিতে দিতে অবশেষে গত বছর সব বিক্রি করে বাজার থেকে বের হয়ে এসেছি। লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় ২৮ লাখ টাকা।”
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আব্বাস উদ্দিন বেনারকে বলেন, “আমার আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করে মোট ১০ লাখ টাকা বাজারে বিনিয়োগ করেছিলাম। আমার মূলধন ৩৪ শতাংশ কমে গেছে। কোনো মতে নিজের মূলধন ফেরত পাওয়ার মতো অবস্থায় এলে বিক্রি করে বাজার থেকে বের হয়ে যাব।”
রেজাউল করিম বেনারকে বলেন, “বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, বাজার ইতিবাচক হবে।”