পরিবর্তিত হচ্ছে কুকুরের প্রজনন মৌসুম: বাড়ছে কুকুরের কামড়

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.05.15
ঢাকা
পরিবর্তিত হচ্ছে কুকুরের প্রজনন মৌসুম: বাড়ছে কুকুরের কামড় একটি বন্ধ দোকানের সামনে বসে আছে পথকুকুর। ছবিটি ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে তোলা। ২৩ নভেম্বর ২০২৩।
[সুদীপ্ত সালাম/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশের রাস্তায় অবস্থানকারী পথকুকুরের প্রজনন মৌসুম ও আচরণ পরিবর্তনের কারণে বাড়ছে কুকুরে কামড়ানো রোগীর সংখ্যা, যাদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৫ বছরের কম।  ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে কুকুরের ওপর বিদ্বেষ বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করছেন প্রাণী বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, প্রজনন মৌসুম পরিবর্তন হওয়ায় কুকুরের হিংস্র আচরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইসাথে, কুকুরের প্রতি মানুষের সহিংসতা এবং খাদ্য সঙ্কটও কুকুরকে হিংস্র করছে।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যাণ্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ রাশেদুল আলম বুধবার বেনারকে বলেন, দুনিয়াজুড়ে কুকুরের সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, বছরে তারা দুইবার বাচ্চা দেয়। তবে আমাদের দেশে অধিকাংশ কুকুর বছরে একবারই বাচ্চা দেয়। জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এরা প্রজননে যায় এবং একটি কুকুর একটানা সর্বোচ্চ নয় দিন পর্যন্ত এই প্রবণতা ধারণ করে। অর্থাৎ তার যৌন চাহিদা থাকে। এর মধ্যে সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে এবং সর্বোচ্চ ৬৩ দিন পর বাচ্চা দেয়।

“তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে যে, কুকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেও প্রজননে লিপ্ত হচ্ছে এবং বছরের বিভিন্ন সময়ে বাচ্চা দিচ্ছে।  ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারাদেশেই নতুন এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।  এতে পথকুকুরের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি কুকুরের কামড়ের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।

ঢাকার মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তথ্য বলছে, কুকুর, বিড়াল, বেজি, বানর ও খ্যাঁকশিয়ালের আক্রমণের শিকার হয়ে ২০২৩ সালে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯৪ হাজার ৩৮০ ব্যক্তি।

এর আগের বছর ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮৯ হাজার ৯২৮ জন।  হাসপাতালে রেকর্ড অনুযায়ী, চিকিৎসা গ্রহণকারীদের মধ্যে দুই–তৃতীয়াংশই কুকুরের আক্রমণের শিকার।  ঢাকা শহরে স্থাপিত এই হাসপাতালটিতে ২০১৫ সালে ২২৬ জন মানুষ কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।  

মানুষের পাশাপাশি কুকরের গবাদিপশু কামড়ানোর ঘটনা বাড়ছে বলেও তথ্যপ্রমাণ পেয়েছেন কর্মকর্তারা।  ২০২১ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,  প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার গবাদি পশু কুকুরের কামড়ের শিকার হয় এবং এর মধ্যে ২৫ হাজার র‌্যাবিস রোগে আক্রান্ত হয় যেগুলোর একটি বড় অংশ প্রাণ হারায়।

২০২০ সালে র‌্যাবিস প্রতিরোধের ওপর প্রস্তুতকৃত সরকারি কার্যপত্রে বলা হয়েছে, কুকুরের কামড়ের কারণে শতকরা ৯৯ ভাগ র‌্যাবিস রোগ হয়।  র‌্যাবিস রোগের প্রাদুর্ভাব প্রধানত ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলার গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়।  

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) আওতায় চলমান জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচীর বিশেষজ্ঞ ডা. মুজিবুর রহমান বুধবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা মাঠ পর্যায়ে দেখেছি যে, পথকুকুরগুলো বছরে একবারই বাচ্চা দেয়, যা সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত।”

তিনি বলেন, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুকুর বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রজনন করছে এবং বিভিন্ন সময়ে বাচ্চা দিচ্ছে।  কেন দিচ্ছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গবেষণা দরকার।

“আমাদের সংস্কৃতি হলো কুকুরকে আঘাত করা।  কুকুরের প্রজননের জন্য ৪৫ মিনিট সময় লাগে।  প্রজননরত অবস্থায় তাদের যখন লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয় তখন সে আক্রমণাত্নক হয়ে কামড় দেয়,” যোগ করেন মুজিবুর রহমান।

এই কর্মকর্তার মতে, সারা দেশে কমপক্ষে ১৬ লাখ পথকুকুর রয়েছে।  স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী ঢাকা শহরে ৭৩ হাজার ৭৭৮টি কুকুর রয়েছে।  তার মানে রাজধানীর প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ১৭টি পথকুকুর রয়েছে।  প্রতিবছর শতকরা আট ভাগ করে পথকুকুরের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

পথকুকুর পর্যবেক্ষক ‍ও তদারককারী তন্ময় ইমরান বুধবার বেনারকে বলেন, “আমার এলাকা মিরপুরের টোলারবাগ এলাকায় একই কুকুর বছরে তিনবার বাচ্চা দিয়েছে।  এটি আগে দেখা যায়নি।”

তিনি বলেন, “তবে বছরে তিনবার বাচ্চা দিলেও দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ বাচ্চাই মারা যাচ্ছে।  মারা যাওয়ার একটি বড় কারণ হলো পারভো ভাইরাস আক্রমণ এবং আরেকটি হলো গাড়ির নীচে চাপা পড়া।”

তিনি বলেন, “কুকুর যখন আক্রান্ত হয় অথবা অস্তিত্বের সঙ্কট বোধ করে অথবা পাগল হয়ে যায় তখনই কুকুর মানুষকে কামড় দেয়।”

তন্ময় ইমরান বলেন, অকারণে কুকুরকে ঢিল মারা অথবা আঘাত করা বাংলাদেশের সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে।  বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এই প্রবণতা বেশি।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “যখন একটি কুকুরকে কেউ ঢিল মারা হয় তখন সে আতঙ্কিত হয়ে সারাদিন উত্তেজিত থাকে ও ভয়ে থাকে।  তখন সে অন্য মানুষকে দেখে আক্রমণাত্নক হয়।”

“তখন সেই মানুষটিও ভয় পায়। অনেক সময় ভয়ে দৌড় দেয় অথবা ঢিল মারে তখন কুকুর কামড় দেয়।”

ইমরান বলেন, “মানুষকে কামড় দেওয়ার আরেকটি কারণ হলো কুকুরের বাচ্চা ফেলে দেয়া।  অনেক সময়ই বাসাবাড়ির গার্ডরা কুকুরের বাচ্চা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয় অথবা হত্যা করে।  বাচ্চা নিয়ে গেলে তো কুকুর আক্রমণাত্নক হবেই!”

তিনি বলেন, “ফলে দেখা যাচ্ছে, মানুষের সাথে কুকুর সংঘাত বাড়ছে এবং কুকুরকে মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না।  তবে, আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি অকারণে কুকুর কামড় দেয় না।”

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে বলে জানিয়েছেন জলবায়ু বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মিজান আর. খান।

তিনি বলেন, এ ব্যাপারে সকলে একমত যে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, অনাবৃষ্টিসহ বিভিন্ন অবস্থা মানুষের জীবনযাত্রার কারণেই হয়েছে।  আবহাওয়ার পরিবর্তিত রূপের কারণে প্রাণীকূলের আচরণের পরিবর্তন হবে এটিই স্বাভাবিক।  কুকুরের ক্ষেত্রেও তেমনটি হতে পারে।  এজন্য গবেষণা দরকার।

 

বাড়ছে কুকুর বিদ্বেষ

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কুকুর বিড়ালসহ বিভিন্ন প্রাণী রক্ষার আন্দোলন জোরদার হয়েছে এবং পরিবেশে এসকল প্রাণীর অবদান স্বীকার করা হয়।

তবে প্রায়ই নির্দয়ভাবে কুকুরকে পিটিয়ে হত্যার চিত্র ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়।

বাংলাদেশে কুকুরের সংখ্যা কমাতে সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভা প্রতিবছর ধরে নিয়ে হত্যা করতো এবং মৃতদেহগুলো ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হতো।

বর্তমানে কুকুর, বিড়ালসহ বিভিন্ন প্রাণী হত্যার দায়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মামলা দায়ের করেন প্রাণী অধিকার কর্মীরা।

ঢাকার বনশ্রীতে ১৬টি কুকুর হত্যার দায়ে ২০১৮ সালের মে মাসে এক ব্যক্তির ছয় মাসের জেল হয়েছে।

২০১৯ সালে প্রাণীকল্যাণ আইন পাশ হয়েছে, যা কুকুরসহ বিভিন্ন প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ করেছে।

কুকুর হত্যা না করে সেগুলোকে বন্ধ্যাকরণের ব্যাপারে আদালতের নির্দেশ রয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।