একজনের মৃত্যু ও জনদুর্ভোগ শেষে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার

ঢাকা থেকে পুলক ঘটক
2017.03.01
পরিবহন ধর্মঘটের কারণে কমলাপুর স্টেশন থেকে যাত্রীরা এভাবে ট্রেনের ছাদে চড়ে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে কমলাপুর থেকে যাত্রীরা এভাবে ট্রেনের ছাদে চড়ে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করেন। মার্চ ০১, ২০১৬।
নিউজরুম ফটো

ব্যাপক জনদুর্ভোগ, সংঘর্ষ ও এক শ্রমিকের মৃত্যু এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর শেষ হয়েছে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট। এ ঘটনায় সরকার বিরক্ত ও বিব্রত। ধর্মঘট ডাকতে ইন্ধন দেওয়ার জন্য অভিযোগের তির সরকারের মন্ত্রী শাজাহান খান ও প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গার দিকে।

ধর্মঘটের কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছিল না। অথচ ধর্মঘট হয়ে গেল দেশ জুড়ে। গত সোমবার রাতে মন্ত্রী শাজাহান খানের বাসা থেকে এ​ই কর্মসূচির সিদ্ধান্ত এসেছিল বলে খবর বেরিয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে মন্ত্রীর নির্দেশেই অচলাবস্থার অবসান হয়েছে। জনদুর্ভোগের জন্য মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করলেও ধর্মঘটে ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তবে এরই মধ্যে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে প্রাণ গেছে একজন পরিবহন শ্রমিকের। দিনভর রাজধানীসহ সারা দেশে ঘর ​থেকে বের হওয়া মানুষের দুর্ভোগ ছিল চরমে।

সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হওয়ায় ২৩ ফেব্রুয়ারি দায়ী বাসচালককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। এর প্রতিবাদে গত রবিবার থেকে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ধর্মঘট শুরু হয়। এর পর সাভারে এক নারীকে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যার দায়ে আরেক চালকের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর শুরু হয় দেশজুড়ে ধর্মঘট।

গাবতলী রণক্ষেত্র

ধর্মঘট চলাকালে রাজধানীর গাবতলী এলাকায় মঙ্গলবার বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এবং বুধবার ভোর থেকে অর্ধদিবস তাণ্ডব চালিয়েছে শ্রমিকেরা। তাদের প্রতিরোধ করে র‍্যাব–পুলিশ।

ঘটনাস্থল থেকে সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে নিয়োজিত দৈনিক সমকালের প্রতিবেদক আবু সালেহ রনি বেনারকে জানান, “মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকেই মিরপুর মাজার রোড থেকে শুরু করে আমিনবাজার পর্যন্ত সড়কের দুই পাশ বন্ধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন শ্রমিকেরা।

আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় পুলিশ বক্স ও পুলিশের একটি রেকারসহ অন্তত চারটি গাড়ি। রক্ষা পায়নি রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স। সড়কের দুই পাশের সিসিটিভি ক্যামেরাও খুলে ফেলা হয়।

“শ্রমিকেরা বিনা উসকানিতেই অন্তত ৪০টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে,” বেনারকে জানিয়েছেন দারুস সালাম থানার ওসি সেলিমুজ্জামান।

গাবতলী এলাকায় পরিবহন শ্রমিকদের তাণ্ডব।
গাবতলী এলাকায় পরিবহন শ্রমিকদের তাণ্ডব।
নিউজরুম ফটো।
মিরপুর এলাকার সাংসদ আসলামুল হক বেনারকে বলেন, “একটি স্বার্থান্বেষী মহল পরিস্থিতি উত্তপ্ত করছে। তাদের প্রতিরোধ করে সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হয়েছে।”

পরিবহন শ্রমিকের মৃত্যু

মঙ্গলবার রাতের পর বুধবার সকালে ফের সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় শাহ আলম (৪৫) নামে একজন বাসচালক পেটে গুলিবিদ্ধ হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় বেলা ১১টার দিকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত শাহ আলম বৈশাখী পরিবহনের চালক ছিলেন বলে জানা গেছে।

পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আহম্মেদ বেনারকে বলেছেন, “শ্রমিকেরা থেমে থেমে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল মারে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে।”

বাস, ট্রাক বন্ধ ছিল

বুধবার বিকেল পর্যন্ত ঢাকা থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছাড়েনি। ঢাকার বাইরে থেকেও আসেনি কোনো বাস।

রাজধানীতে সকাল থেকেই তীব্র পরিবহন সংকট দেখা দেয়। দুর্বিষহ ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। বিআরটিসি’র বাস, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, রিকশা ছাড়া আর কোনো পরিবহন ছিল না।

অটোরিকশা, রিকশায় তিন-চার গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে যেতে হয়েছে মানুষকে। অসংখ্য মানুষকে হেঁটে চলাচল করতে দেখা গেছে।

মন্ত্রীর মদদে ধর্মঘট!

পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটে সরকারের একজন মন্ত্রী মদদ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

বুধবার এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, “পরিবহন ধর্মঘটের পেছনে যিনি মদদ জোগাচ্ছেন, তিনি সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। সরকার এই সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে।”

এ ঘটনার নেপথ্যে প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমানের সংশ্লিষ্টতারও অভিযোগ রয়েছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান বেনারকে বলেন, “তাঁদের সিদ্ধান্ত ছাড়াই বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা ধর্মঘট করছেন।”

নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বাসায় পরিবহন খাতের নেতাদের বৈঠক সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “ওই দিন তাঁরা খুলনার ১০ জেলার ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়ে আলোচনার জন্য বসেছিলেন। ওই মুহূর্তে একজন বাসচালককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার খবর আসলে শ্রমিকনেতারা উত্তেজিত হন। নির্দেশ ছাড়াই তারা নিজেদের মতো ধর্মঘট শুরু করেন।”

হাইকোর্টের নির্দেশ

ধর্মঘট প্রত্যাহারের নির্দেশনা চেয়ে বুধবার একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সারা দেশে স্বাভাবিক যান চলাচল নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আদালতের রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে হরতাল ও ধর্মঘটের মতো কর্মসূচি কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং আহ্বানকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দেন। এই রুলের পর দৃশ্যপট বদলে যায়। কোনোরকম দাবি বা শর্ত ছাড়াই ধর্মঘট প্রত্যাহার করে পরিবহন শ্রমিক–মালিকেরা।

নৌ পরিবহন মন্ত্রীর আহ্বান

পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চারটি সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে সংবাদ সম্মেলনে আসেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে পরিবহন শ্রমিকদের যানবাহন চালানোর আহ্বান জানান।

যান চলাচল শুরু

নৌমন্ত্রীর আহ্বানের পর রাজধানীসহ সারা দেশে যান চলাচল শুরু হয়েছে। গাবতলী শান্ত হয়েছে। অনেক পরিবহনের কাউন্টার টিকিট বিক্রি শুরু করেছে। আবার অনেকে কাউন্টার খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বেনারকে জানিয়েছেন, “বুধবার সন্ধ্যার পর দূর পাল্লার সব পরিবহন চলাচল করবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।