কোটা সংস্কার দাবিতে সর্বাত্মক ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি
2024.07.09
ঢাকা
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা সরকারি পরিপত্র পুনর্বহালসহ চার দফা দাবিতে গত ১ জুলাই থেকে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যানারে সড়ক অবরোধের পাশাপাশি চলছে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা জনদুর্ভোগ না করে আন্দোলনের পথ পরিহার করবেন এবং আদালতের মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করবেন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলাটিতে পক্ষভুক্ত হতে ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীরা আবেদন করলেও মাঠের আন্দোলন প্রত্যাহার করেননি শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার ঘোষিত নতুন কর্মসূচি অনুযায়ী বুধবার দেশজুড়ে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সর্বাত্মক 'বাংলা ব্লকেড' কর্মসূচি পালন করবেন তাঁরা। মহাসড়ক এবং রেলপথও ব্লকেডের আওতায় থাকবে।
কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর করা আবেদন বুধবার আপিল বিভাগে শুনানির জন্য নির্ধারণ করেছেন চেম্বার বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন এবং সর্বজনীন পেনশন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম। সড়ক অবরুদ্ধ থাকায় ব্যাহত হচ্ছে নিয়মিত কর্মকাণ্ড। তাই সমঝোতার মাধ্যমে সরকারকেই শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
আদালতের আদেশে পরিপত্র বাতিল হলেও সরকারের পক্ষ থেকে নতুন করে পরিপত্র জারি করতে কোনো বাধা নেই বলে মনে করেন সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান।
তিনি বেনারকে বলেন, “সরকার তার বিবেচনা অনুযায়ী সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে আরেকটি পরিপত্র জারি করতে পারে। আদালত এ ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেবে না। কোটাকে যৌক্তিক করে একটি আইন করা যেতে পারে, আবার নির্বাহী আদেশেও সমাধান করা যেতে পারে।”
সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন করপোরেশনে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট করা হয়েছিল। যার চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গত ৫ জুন হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন।
স্বাধীনতার পর থেকেই কোটা ছিল। বিভিন্ন সময় তা কম-বেশি হয়। ২০১৮ সালে কোটা ৫৬ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা, পাঁচ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং এক শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা। পরবর্তীতে কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তারপর নাতি-নাতনি যুক্ত করা হয়।
কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলনে নামে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। আন্দোলনের একপর্যায়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাপদ্ধতি তুলে দেয় সরকার।
ওই বছরের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, নবম গ্রেড এবং দশম থেকে ১৩তম গ্রেডের ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে (১৪তম থেকে ২০তম গ্রেড) কোটাব্যবস্থা বহাল রাখা হয়।
ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। আইনি ধারাবাহিকতায় গত ৫ জুন পরিপত্রটি স্থগিত হয়। ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করে।
কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র নাহিদ ইসলাম বেনারকে বলেন, “এটা এখন সরকার ও শিক্ষার্থীদের সমঝোতার বিষয়। আমরা চাচ্ছি সরকার সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে সব গ্রেডের চাকরিতে কোটা সংস্কার করে একটি যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসুক।”
দুই দিন ব্লকেড কর্মসূচির পর মঙ্গলবার গণসংযোগ করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ।
আইনি লড়াই
কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আল সাদী ভুঁইয়া বলেন, “কোটা পুনর্বহাল করে উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আমি ব্যক্তিগতভাবে আপিল করেছি।”
উচ্চ আদালত ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র বহাল রাখবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
রাজপথে নয়, সমাধান আদালতে
কোটা নিয়ে চলমান সমস্যার সমাধান রাজপথে সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তিনি বেনারকে বলেন, “আন্দোলনকারীদের যদি কোনো বক্তব্য থাকে, তাহলে তারা আদালতে গিয়ে বলতে পারেন।”
আইনমন্ত্রী বলেন, “উচ্চ আদালতে যখন এই সংক্রান্ত মামলার শুনানি হয় তখন তাদের কোনো আইনজীবী ছিল না। এখন এটা রাজপথে সমাধান হওয়ার সুযোগ নেই। ”
এর আগে গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা এই মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ার জন্য আপিল বিভাগে দরখাস্ত করেছে এবং আগামীকাল বোধ হয় শুনানি হবে। আমি মনে করছি, তারা সঠিক পথে হাঁটছেন।
আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগকে সতর্ক থাকার আহ্বান
শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের আন্দোলনের ব্যাপারে দলের নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকতে বলেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আয়োজিত যৌথসভায় তিনি বলেন, “শিক্ষকদের আন্দোলনও অরাজনৈতিক এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও অরাজনৈতিক। এই অরাজনৈতিক আন্দোলনে বিএনপি এবং তাদের সমমনষ্কদের কারও কারও রাজনৈতিক সমর্থনের বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।”
তিনি বলেন, “এই মহলটি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দাবির বিষয়কে উসকানি দিয়ে-ইন্ধন দিয়ে যাতে দেশে একটি বিশৃঙ্খলার আবহ তৈরি করতে না পারে, সে ব্যাপারে সর্বত্রই আমাদের সাবধান থাকতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে।”
উল্লেখ্য, কোটা সংস্কারের দাবিকে যৌক্তিক উল্লেখ করে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো।