রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ: ইউনেস্কোর আপত্তি বহাল, সরকারও অনড়
2017.07.31
ঢাকা
সুন্দরবনের অদূরে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে ইউনেস্কো আপত্তি তুলে নিয়েছে বলে যে দাবি সরকার করেছিল, সংস্থাটির প্রকাশিত সিদ্ধান্তে তার উল্লেখ নেই। বরং সুন্দরবন এলাকায় কৌশলগত পরিবেশ মূল্যায়নের (এসইএ) আগে সেখানে বড় কোনো শিল্প বা অবকাঠামো নির্মাণ করা না করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউনেস্কো।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সুন্দরবন ও রামপাল বিষয়ে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ৪১তম সভার প্রকাশিত সিদ্ধান্তে এমন আহ্বান জানানো হয়েছে। গত রোববার সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এটি প্রকাশিত হয়।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চলবে, সঙ্গে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও নির্মাণ করা হবে।
সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রামপাল প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যেতে কোনো বাধা নেই। ড. তৌফিক পোল্যান্ডের ক্রাকাও শহরে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪১তম সভায় অংশ নেন।
তাঁর মতে, ইউনেস্কোর খসড়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুন্দরবনের আশপাশে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কোনো বড় শিল্প বা অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে তারা রামপাল প্রকল্পের কথা বাদ দিয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে শুধু শিল্প এবং বড় অবকাঠামোর কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে সরকার একমত পোষণ করেছে।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী আরও বলেন, ইউনেস্কোর খসড়া প্রতিবেদনে সুন্দরবনের যে বিপদের কথা বলা হয়েছিল, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে তা রাখা হয়নি। স্ট্র্যাটেজিক এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট (এসইএ) করে দেখা হবে যে ওই অঞ্চলে আরও কোনো বড় শিল্প বা অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে কি না। ওই অ্যাসেসমেন্টে যদি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে সেটি নিরসনে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ৪১তম ওই বৈঠকের প্রকাশিত সিদ্ধান্তে এসইএ শেষ করে এর প্রতিবেদনের একটি কপি দ্রুত হেরিটেজ সেন্টারে পাঠাতে সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে। এটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারকে (আইইউসিএন) দিয়ে পর্যালোচনা করবে হেরিটেজ সেন্টার।
এর আগে বৈঠকটি চলাকালেই গত ৭ জুলাই এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ২ জুলাইয়ের অধিবেশনে ইউনেস্কো রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে তাদের আপত্তি তুলে নিয়েছে। পাশাপাশি বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে সুন্দরবনের নাম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তও বাতিল হয়েছে।
পরিবেশ ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সরকারের বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউনেস্কোর চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুসারে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সংস্থাটির তোলা আপত্তি এখনো বহাল রয়েছে।
“সরকারের অনড় অবস্থান সুন্দরবনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে,” বেনারকে বলেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ।
তিনি বলেন, “ইউনেস্কোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত থেকেই বোঝা যায়, রামপাল প্রকল্পে ইউনেস্কো আপত্তি তুলে নিয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে মিথ্যা বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে।”
আনু মুহম্মদ বলেন, “ইউনেস্কোর সভায় সরকার সংস্থাটির সিদ্ধান্ত মানার অঙ্গীকার করে এসেছে। সে অঙ্গীকার পালন করতে হলে অবশ্যই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ বন্ধ করতে হবে। শুধু তাই নয়, কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানই সুন্দরবনের আশে-পাশে নির্মাণ করা যাবে না।”
১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্বের ৫২২তম বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান দেয় ইউনেস্কো। সুন্দরবনের ইউনেস্কো হেরিটেজ থেকে ৬৯ কিলোমিটার এবং বনটির উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত সীমা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে। ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ভারতীয় কোম্পানি ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালকে (ভেল) গত এপ্রিলে কাজ শুরুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। দুই ইউনিটের কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের নির্মাণকাজ ৪১ মাস এবং দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণকাজ ৪৭ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে পরিবেশবাদীরা আন্দোলন শুরু করলে ২০১৪ সালের ১১ জুলাই সরকারকে দেওয়া চিঠিতে এ বনের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সরকার ব্যর্থ হলে সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান হারাবে বলে সতর্ক করে ইউনেস্কো। প্রকল্পটি অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করে সংস্থাটি।
ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তে যা আছে
বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সিদ্ধান্তে বলা হয়, রামপালে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে সুন্দরবনের পানি ও বায়ু দূষণ বাড়বে। নৌচলাচল বাড়ায় ড্রেজিংয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। প্রচুর মিঠা পানি তোলার প্রয়োজন হবে। আর এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। সমীক্ষার মাধ্যমে এই প্রভাব নিরূপণ এবং সুন্দরবনের ক্ষতি প্রশমনের উপায়ের বিস্তারিত এসইএ প্রতিবেদনে থাকতে হবে।
গত বছরের মার্চে সুন্দরবন সফর করে অক্টোবরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচারের (আইইউসিএন) রিঅ্যাকটিভ মনিটরিং মিশনের একটি প্রতিনিধি দল। ওই প্রতিবেদনের সুপারিশ এবং এসইএসহ অন্যান্য সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানিয়ে হেরিটেজ কমিটি বাংলাদেশ সরকারকে ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে। ২০১৯ সালে কমিটির ৪৩তম অধিবেশনে এসব প্রতিবেদনের পর্যালোচনা করা হবে।
২০১৬ সালের প্রতিবেদনে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি দল রামপালকে সুন্দরবনের জন্য ‘মারাত্মক হুমকি’ হিসেবে উল্লেখ করে প্রকল্পটি অন্য স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করে। অন্যথায় সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা বাতিল করে একে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়।
তবে আলোচনার পর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির সর্বশেষ সভায় সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ প্রাকৃতিক নিদর্শনগুলোর তালিকায় যুক্ত করার প্রস্তাব বাতিল করা হয়।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বেনারকে বলেন, “রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না, বরং দক্ষিণাঞ্চলে উন্নতি বয়ে আনবে।”
এদিকে রামপাল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল সরকার। ওই এলাকায় আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল ওরিয়ন গ্রুপ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তবে ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর প্রতিবেদন প্রকাশের পর এসব সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। ৪১ তম সভায় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় হেরিটেজ কমিটি।