বিনা বিচারে আটক সাতজনকে কেন জামিন নয়, জানতে চেয়ে রুল
2016.12.15
ঢাকা থেকে

বিনা বিচারে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে থাকা সাত বন্দীকে আগামী ২৪ জানুয়ারি হাজির করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত।
পাশাপাশি তাদের কেন জামিন দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব মামলার নথি তলব করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার স্বতঃপ্রণোদিতভাবে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ এ আদেশ দেয়।
এই সাত জনের মধ্যে দু’জন ১১ বছর, দু’জন ১২ বছর এবং অপর তিনজন ১৩ বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন। এদের মধ্যে একজন আদিবাসী গারো তরুণ।
দেশের কারাগারগুলোতে প্রায় পাঁচশ বন্দী এমন বিনা বিচারে আটক রয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিনা বিচারে এভাবে আটক রেখে তাদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘণ করা হয়েছে বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তাদের জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তাঁরা।
তবে সরকার বলছে, এদের পক্ষে কেউ আইনি লড়াই চালিয়ে না যাওয়ায়, দীর্ঘদিন ধরে বিনা বিচারে আটক রয়েছেন তারা।
পৃথক পৃথক মামলায় আটক এই সাত ব্যক্তি হলেন- রাজধানীর বাড্ডার সাইদুর রহমান, মতিঝিলের মাসুদ, গাজীপুরের বোর্ড বাজারের বাবু, কেরানীগঞ্জের রাজীব হোসেন, কুষ্টিয়ার রাসেল শেখ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পারভেজ ও নেত্রকোণার গারো তরুন লিটন।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার হওয়া এ বিষয়ক একটি প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করলে বিচারক এই আদেশ দেন। প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির প্যানেল আইনজীবী বেহেশতী মারজান।
এ বিষয়ে আইনজীবী মারজান সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ২৪ জানুয়ারি বন্দি সাত জনকে আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। এভাবে আটক রাখার বিষয়টিকে আদালত মৌলিক অধিকার পরিপন্থি বলে উল্লেখ করেছেন।”
সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘণ
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বেনারকে বলেন, “বিচার পাওয়া একজন মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। বিনা বিচারে কাউকে আটক রাখা যাবে না, সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে। অথচ সেটা মানা হচ্ছে না।”
“এমন অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে এসব ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত”- বলেও জানান তিনি।
তবে পুরোপুরি এর দায় ঘাড়ে নিতে অস্বীকার করেছে সরকার। এ প্রসঙ্গে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল শহীদুল ইসলাম খান বেনারকে বলেন, “আটক এসব ব্যক্তিদের জন্য আইনি লড়াই করার কেউ না থাকাই অন্যতম কারণ। জামিন পেতে হলে সেটা কাউকে না কাউকে চাইতে হবে।”
“এ ছাড়া অনেক সময় আসামিরা নিজে স্বীকারোক্তি দিয়ে থাকেন। এমন ক্ষেত্রে ট্রায়াল শেষ না হলে তারা বিচার পান না”- যোগ করেন তিনি।
ফুট ফরমায়েশ খেটেই সময় পার
দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে থাকতে থাকতে এরা এরা সেখানকার কর্মকর্তাদের বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন। এসব কর্মকর্তারাই তাদেরকে দিয়ে নিজেদের ফুট ফরমায়েশ খাটান।
এ প্রসঙ্গে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর নামের বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদক মাসউদুর রহমান বেনারকে বলেন, “আটক থাকা এসব ব্যক্তিদের দিয়ে কারাগারের ভেতরে নানা ধরনের কাজ করিয়ে থাকেন জেলের কর্মকর্তা কর্মচারিরা। এ কারণে তাদেরকে জেল থেকে বের করার মানবিকতাটুকু এসব কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজ করে না।”
মাত্র কিছুদিন আগে মাসউদুরের একটি প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ১৭ বছর পরে কারাগার থেকে জামিন পান শিপন নামের এক ব্যক্তি।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,- “এই দীর্ঘ সময়ে শিপন জেল কর্মকর্তাদের ফুট ফরমায়েশই খেটেছেন। জেল কর্তৃপক্ষ বাকি কোনো কাজের প্রশিক্ষণ তাকে দেয়নি। ফলে এখন ছাড়া পেয়ে অন্যের উপর নির্ভর করেই তাঁকে বাঁচতে হচ্ছে। ১৭ বছরে পরে জেল থেকে বেরিয়ে সহজে সমাজে মেলাও তার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে।”
তাঁর মতে, “আটক থাকা নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র উদাসীনতা দেখিয়েছে।”
এদিকে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইডের উদ্যোগে সারা দেশের কারাগারগুলোতে বিনা বিচারে আটক ব্যক্তিদের একটি তালিকা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত লিগ্যাল এইড ৪৬২ জন ব্যক্তি পেয়েছে বলে জানা যায়; যারা অন্তত সাত বছরের বেশি সময় ধরে আটক রয়েছেন।
কে কতদিন ধরে আটক
লিগ্যাল এইড প্যানেল থেকে জানা যায়, কাফরুল থানায় একটি মামলায় ২০০৪ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে কারাগারে রয়েছেন কুষ্টিয়ার রাসেল শেখ। বর্তমানে ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ওই মামলায় এ পর্যন্ত ৫৫ কার্যদিবস আদালতে হাজির করা হয়েছে রাসেলকে।
২০০৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে বাড্ডার সাইদুর রহমান নারী নির্যাতনের একটি মামলায় কারাগারে রয়েছেন। এ পর্যন্ত ৫৯ বার ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে তাকে।
২০০৪ সালের ২ জুলাই গ্রেপ্তার হওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পারভেজও নারী নির্যাতন মামলার আসামি। এ পর্যন্ত ৪২ কার্যদিবস আদালতে হাজির হয়েছেন তিনি।
২০০৩ সালের ১ এপ্রিল থেকে কারাগারে মতিঝিলের মাসুদ। কেরানীগঞ্জের রাজীব গ্রেপ্তার হন ২০০৩ সালের ৬ ডিসেম্বর। ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন মামলাটিতে তিনি এ পর্যন্ত ৪৪ কার্যদিবস আদালতে হাজির হয়েছেন।
২০০৫ সালের ২৩ জানুয়ারি এক মামলায় কারাগারে ঢোকানো হয় নেত্রকোণার লিটনকে। এ পর্যন্ত ৫৮ কার্যদিবস আদালতে হাজির করা হয়েছে তাকে। আর ২০০৩ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে আটক রয়েছেন গাজীপুরের বাবু। তাকেও এ পর্যন্ত ৪৪ কার্য দিবস আদালতে হাজির করা হয়েছে।