আইএসের অনুমতি নিয়েই গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় তামিম

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.12.01
হলি আটির্জান থেকে জিম্মিদের উদ্ধারে পরিচালিত সেনা অভিযান গুলশানে হলি আটির্জান রেস্তোরাঁ থেকে জিম্মিদের উদ্ধারে পরিচালিত সেনা নেতৃত্বাধীন অভিযান। জুলাই ০১, ২০১৬।
স্টার মেইল

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনায় জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সংশ্লিষ্টতা ছিল না বলে দাবি করে আসছে সরকার। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোও যেসব তথ্যপ্রমাণ হাজির করছে, তা সরকারের এই মতকেই প্রতিষ্ঠিত করে।

কিন্তু পুলিশের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি সংবাদ বলছে, ওই হামলার সন্দেহভাজন পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরী হামলার আগে আইএসের অনুমতি চেয়েছিল। আইএস তাকে হামলা পরিচালনা করার অনুমতিও দিয়েছিল।

রয়টার্সের ওই সংবাদে বলা হয়েছে, তামিম ও তাজউদ্দিন কাওসারের মধ্যে যোগাযোগ সম্পর্কে অবহিত পুলিশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তাদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে তথ্যের সংবেদনশীলতার কারণ দেখিয়ে তামিম ও তাজউদ্দিনের এসব বার্তার খবর জানানো ওই পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর নাম প্রকাশে রাজি হননি। আবার রয়টার্স কথোপকথনের বিষয়টি যাচাই করতে পারেনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

বাংলাদেশ পুলিশ ও র‍্যাবের আনুষ্ঠানিক দাবি হচ্ছে, দেশে গড়ে ওঠা জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির সদস্যরাই গুলশান হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, র‍্যাব ও পুলিশের প্রধানেরা একবাক্যে বাংলাদেশে আই​এসের উপস্থিতি নাকচ করে চলেছেন।

দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোও সরকারের এই অবস্থানকে সেই অর্থে চ্যালেঞ্জ করেনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার এই খবর গুলশান হামলায় আইএসের সম্পৃক্ততার বিষয়টি তুলে ধরেছে।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী (৩০) আইএসের আবু তারেক মোহাম্মদ তাজউদ্দিন কাউসারের (৩৫) সঙ্গে যোগাযোগ করে হামলাটি পরিচালনা করে। তাজউদ্দিনও একজন বাংলাদেশি।

তামিম চৌধুরী। ফাইল ফটো
তামিম চৌধুরী। ফাইল ফটো
স্টার মেইল

পুলিশের ওই কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, তামিমকে বিদেশিদের নিশানা (টার্গেট) করতে বলেছিল তাজউদ্দিন। প্রায়ই বিদেশিরা যাতায়াত করেন—ঢাকার এমন একটি রেস্তোরাঁয় হামলা চালানোর প্রস্তাব করে তামিম। তামিম ও তাজউদ্দিনের মধ্যে যেসব বার্তা চালাচালি হয়েছে, তাতে আইএসের সাময়িকীতে পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত কিছু নিবন্ধের খসড়াও ছিল বলে জানিয়েছেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

তিনি বলেছেন, তথ্যপ্রমাণে দেখা গেছে, জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য সদস্য নিয়োগ এবং অর্থায়নের চেষ্টায় আইএসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বাংলাদেশের স্থানীয় জঙ্গিদের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ গড়ে তোলে। এ বিষয়টি আগে অজানা ছিল।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান মাসুদুর রহমান রয়টার্সের এই সংবাদের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, সরকারের যে অবস্থান তা তার জানামতে একইরকম আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাহফুজুল হক মারজান বেনারকে বলেন, তামিম কানাডা থেকেই উগ্রপন্থী হিসেবে বাংলাদেশে এসেছে। সেখানে তার সঙ্গে সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে যাওয়া জঙ্গিদের একটা সম্পর্ক ছিল। সে বাংলাদেশে এসে নব্য জেএমবি ও আইএসের মধ্যে একটা সেতু হিসেবে কাজ করত যা আইএসের দাবিক ম্যাগাজিনেও বলা হয়েছে।

পোশাক খাত নিশানা হতে পারে

বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে রয়টার্স বলেছে, আইএস তার উৎপত্তিস্থল ইরাক ও সিরিয়ায় চাপের মুখে পড়ায় বাংলাদেশের মতো বাইরের দেশগুলোতে তৎপরতা জোরালো করতে পারে। তারা বাংলাদেশের পোশাক খাতকে গুরুত্বপূর্ণ নিশানা বানাতে পারে।

বাংলাদেশে এই খাতে লাখো শ্রমিক কাজ করছেন এবং রপ্তানি করে এ খাত থেকে বাংলাদেশের আয় প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার। বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের যেকোনো চিহ্ন পশ্চিমা বিশ্বের নামীদামি ব্রান্ডগুলোকে সস্তায় অন্য দেশ থেকে পোশাক আমদানিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

উল্লেখ্য, হলি আর্টিজানের ওই হামলার আগের এক বছর ধরে বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন ব্লগার ও বিদেশি নাগরিকের ওপর হামলার ঘটনা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করে তোলে।

তামিম তাজউদ্দিনের যোগাযোগ ছিল

গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হয় তামিম। রয়টার্সের ওই সংবাদে বলা হয়েছে, তামিমের ওই আস্তানা এবং অন্যান্য আস্তানায় পুলিশের অভিযানের পর তাঁর সঙ্গে আইএসের তাজউদ্দিনের যোগাযোগের বিষয়ে জানতে পারে পুলিশ।

পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেছেন, একটি বার্তায় তাজউদ্দিন একটি সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে তামিমকে অনুরোধ করেন। এই সাক্ষাৎকারটি আইএসের ম্যাগাজিন দাবিকের এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, যেখানে তামিমকে আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নামে উপস্থাপন করা হয়। তাকে সেখানে বাংলাদেশে আইএসের প্রধান হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।

অন্য আরেকটি বার্তায় তামিম হলি আর্টিজানে হামলার বিষয়ে একটি নিবন্ধের খসড়া তাজউদ্দিনের কাছে পাঠিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর সেই নিবন্ধ আইএসের সাময়িকী রুমাইয়াহতে প্রকাশিত হয়।

বাংলাদেশ বসবাসকারী তাজউদ্দিনের মা তাহেরা বেগম বলেছেন, তাঁর ছেলে ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। গুলশানের হামলার আগ থেকেই ছেলের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। আইএসের সঙ্গে তাঁর ছেলের কোনো যোগাযোগ ছিল কি না তাও তিনি জানেন না।

আইএস বিতর্ক চলছেই

গত ১ জুলাই রাত রাত ৮টা ৪২ মিনিটে গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় পাঁচ জঙ্গি। রেস্তোরাঁর ভেতরে থাকা দেশি-বিদেশি ২০ নাগরিককে নৃশংসভাবে হত্যা করে তারা। জঙ্গিদের বোমায় নিহত হন পুলিশের দুজন কর্মকর্তা।

পরদিন সকালে সেনা নেতৃত্বে পরিচালিত যৌথ অভিযানের মধ্য দিয়ে জঙ্গিদের ১২ ঘণ্টার জিম্মি সংকটের অবসান হয়। ওই অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। আহত হন র‍্যাব ও পুলিশের মোট ৪১ জন।

আইএসের পক্ষ থেকে ওই ঘটনার দায় স্বীকার করা হয়। আইএস তাদের পাঁচ সদস্য নিহত হওয়া, রেস্তোরাঁয় নির্মম হত্যার বর্ণনাসহ যেসব তথ্য আগাম প্রকাশ করে, সেগুলো অনেকাংশেই পরে সত্য বলে প্রমাণ হয়।

“দেশে আইএস নেই বলে বিষয়টা উপেক্ষা করা হচ্ছে,” বলেন মাহফুজুল হক। তাঁর মতে, জঙ্গিবাদকে সরকার এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। র‍্যাব–পুলিশের ফোকাস হচ্ছে নব্য জেএমবি। কিন্তু আল কায়েদার অনুসারী আনসার আল ইসলাম এখনো সক্রিয়।

ওই শিক্ষক বলেন, “চাপের মুখে জঙ্গিবাদ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এটা সত্য হলেও বাস্তবতা হচ্ছে এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান আসবে না। এর আগে জেএমবি নিশ্চিহ্ন হয়েছে বলা হলেও পরে দেখা গেল, বিভিন্ন নামে জেএমবি সদস্যরা বেরিয়ে আসছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।