তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ ৫ নিহতের ঘটনায় বাস চালকের যাবজ্জীবন

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2017.02.22
রায় ঘোষণার পর বাস চালক জামির হোসেনকে জেলে পাঠানো হয়। রায় ঘোষণার পর বাস চালক জামির হোসেনকে জেলে পাঠানো হয়। ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৭।
স্টার মেইল

আপডেটঃ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ইস্টার্ন টাইম বিকেল ০৩.১৫

প্রায় অর্ধযুগ পর বিচার পেলেন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীরসহ পাঁচ নিহতের পরিবার। নৃশংস ওই দুর্ঘটনার পর দায়ের করা মামলায় বাসচালক ও একমাত্র আসামি জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

গতকাল বুধবার মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আল-মাহমুদ ফায়জুল কবীর এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে অবহেলাজনিত হত্যার দায়ে (পরিকল্পিত নরহত্যা নয়) দোষী সাব্যস্ত করে বাস চালককে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার সময় আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে সড়ক দুর্ঘটনা মামলার ওই রায়কে মাইলফলক বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা এই রায় দ্রুত কার্যকর করার পাশাপাশি সড়ক ব্যবস্থাপনায় আরো শক্তিশালী আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন নিহত হওয়ার পর থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। তাঁর সংগঠনের নাম ‘নিরাপদ সড়ক চাই’। এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস বেনারকে বলেন, “আমরা চাই নতুন আইনে জামিন অযোগ্য ধারাটি আবার চালু করা হবে। এতে করে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমবে, চালকদের মধ্যে ভয় থাকবে।”

গতকালের এই রায়ে সস্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজনেরা। নিহত মিশুক মুনীরের সহোদর আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “এই রায় একটা মাইলস্টোন। একে দৃষ্টান্ত ধরে ভুক্তভোগী সবাই এখন মামলা করার সুয়োগ পাবেন। তবে বিদ্যমান আইনের পরিবর্তন দরকার।”

তাঁর প্রত্যাশা, উচ্চ আদালতেও এই রায় বহাল থাকবে।

নিহত তারেক মাসুদ এর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ সেই দুর্ঘটনায় আহতদের একজন। রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে এক ভিডিও বার্তায় ক্যাথরিন বলেন, “আশা করি এই রায়ের কারণে ভবিষ্যতে সড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার হবে এবং আরো অনেকের জান বাঁচবে।”

তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনির (ডানে)।
তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনির (ডানে)।
ফাইল ছবি: তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা ফেরার পথে ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। তারেক মাসুদসহ অন্যরা নতুন ছবি ‘কাগজের ফুল’ এর শুটিং স্পট দেখতে মানিকগঞ্জ গিয়েছিলেন। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বেপরোয়া গতিতে চালানো একটি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন মাইক্রোবাস আরোহী তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন।

নিহত অন্যরা হলেন; তারেক মাসুদের প্রোডাকশন ম্যানেজার ওয়াসিম, কর্মী জামাল ও মাইক্রোবাসের চালক মুস্তাফিজ।

দুর্ঘটনায় আহত হন একই মাইক্রোবাসের আরোহী তারেকের স্ত্রী চলচ্চিত্রকার ক্যাথরিন মাসুদ, প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ঢালী আল-মামুন ও তাঁর স্ত্রী দিলারা বেগম জলি এবং তারেকের প্রোডাকশন ইউনিটের সহকারী সাইদুল ইসলাম।

ঘটনার দিনই বাসচালক জামির হোসেনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন ঘিওর থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) লুৎফর রহমান।

গতকাল রায়ের পরে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আফছারুল ইসলাম মনি সাংবাদিকদের বলেন, “ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় আসামিকে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবনের পাশাপাশি পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের জেল দিয়েছেন আদালত।”

“এ ছাড়া আরেকটি ধারায় আদালত আসামিকে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, দুই হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। এই উভয় সাজা একসঙ্গে চলবে,” জানান ওই আইনজীবী।

তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী মাধব রায় সাংবাদিকদের বলেন, “এ রায়ে আসামি সংক্ষুব্ধ। তিনি রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। সেখানে তিনি খালাস পাবেন বলে প্রত্যাশা করি।”

পুলিশ জানায়, দুর্ঘটনার দুদিন পরে আসামি জামির গ্রেপ্তার হন। ২০১১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে উপস্থাপন করে পুলিশ। সে বছরের শেষ দিকেই জামিনে মুক্ত হন জামির। এরপর তিনি নিয়মিত হাজিরা দিয়ে আসছেন।

গতকাল রায় ঘোষণর পর তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। তিন পুলিশ সদস্যসহ রাষ্ট্রপক্ষের ৩৯ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৪ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন।

একই দুর্ঘটনায় আহত ‍চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুন বেনারকে বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনার ইতিহাসে এ ধরনের রায় প্রথম। এটি কার্যকর হলে ভুক্তভোগী মানুষ আশাবাদী হবে। তবে সড়ক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্রণিধানযোগ্য নির্দেশনা রায়ে আশা করেছিলাম।”

ব্যক্তির কারণে এমন রায়

নিহত তারেক মাসুদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র মুক্তির গান ও মাটির ময়না প্রশংসিত হয়।

আর সাংবাদিকতার সাবেক শিক্ষক মিশুক মুনীর ছিলেন টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ও গণমাধ্যমে তাঁদের এই পরিচিতির কারণে এ সংক্রান্ত মামলাটি হাইপ্রোফাইল হিসেবে গণ্য হয়। যার প্রভাব রায়ে পড়েছে বলে মনে করেন সাধারণ নাগরিকেরা।

এ প্রসঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত আবু তালেব বেনারকে বলেন, “প্রতিদিন সারা দেশে অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনায় কত প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। কিন্তু বিচার পাওয়া দূরে থাক, মামলা করারই আগ্রহ বা সাহস পায় না সাধারণ মানুষ। যেসব মামলা হয় তারও বিচার পেতে দীর্ঘ সময় চলে যায়।”

তাঁর মতে, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর হাইপ্রোফাইল হওয়ায় তাদের মামলা গতি পেয়েছে বা সাজা হয়েছে।

বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করে মিশুক মুনীরের ভাই আসিফ মুনীর বলেন, “এটা একটা হাইপ্রোফাইল কেস। মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদ গণমাধ্যমে, সাংস্কৃতিক মণ্ডলে সুপরিচিত ছিলেন বলে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে আইনি লড়াই করা হয়েছে। তবে এমন দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। তাঁদের পরিবারও যেন এ ধরনের আইনি সহায়তা সরকারের পক্ষ থেকে পায়।

তবে হাইপ্রোফাইল কেস হওয়া সত্ত্বেও বিচারে অনেক সময় লেগেছে এবং প্রভাবশালীদের হুমকির মুখে রাষ্ট্রপক্ষের সব সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে পারেন নি বলে অভিযোগ করেন আসিফ মুনীর। তিনি বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দিতে আইনের পরিবর্তন দরকার।”

“যারা চালকদের অল্প প্রশিক্ষণে গাড়ি চালাতে দেয়, গাড়ির যন্ত্রপাতি টেম্পারিংয়ে সহায়তা করে এবং ঘুষের বিনিময়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়—এদের সবাই অপরাধী। আইনি প্রক্রিয়ায় তাদেরকেও আনতে হবে,” মত দেন আসিফ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।