ওয়াজ–মাহফিলে প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য, ১৫ বক্তা শনাক্ত

প্রাপ্তি রহমান
2019.04.02
ঢাকা
190402_hate_speech_congregration_1000.JPG ঢাকায় ঈদে মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠানে ইসলাম ধর্মীয় বয়ান শুনছেন শ্রোতারা। ২১ নভেম্বর ২০১৮।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

সাম্প্রদায়িকতা, নারী বিদ্বেষ ও জঙ্গিবাদ ছড়ানো এবং দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী বয়ান দেওয়ার অভিযোগে ১৫ জন ইসলামি বক্তাকে শনাক্ত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাঁদের ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে করণীয় নির্ধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষণা বিভাগের পরিচালক নূর মোহাম্মদ আলম বলেন, সপ্তাহখানেক আগে তাঁরা এ সম্পর্কিত চিঠি পেয়েছেন। বক্তাদের নাম ও তাঁরা ওয়াজ মাহফিলে কী বলছেন, সে সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁদের জানিয়েছে।

“আমরা সারা দেশের আলেম-ওলামাদের নিয়ে বৈঠক করব। ওয়াজ মাহফিলে বক্তারা যা বলছেন, সেটা ধর্মীয়ভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য তাঁরা বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেবেন। তার ভিত্তিতে আমরা করণীয় ঠিক করব,” বেনার নিউজকে বলেন নূর মোহাম্মদ আলম।

আগামী সপ্তাহে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, ওয়াজ মাহফিলে কোনো কোনো ধর্মীয় বক্তা বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য ছড়াচ্ছেন, এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ ছিল। এবারই প্রথম সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলো।

তবে এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন ধর্মীয় বক্তারা। এর মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ এনেছেন তাঁরা।

চিহ্নিত ১৫ জন বক্তার মধ্যে একজন মামুনুল হক। তিনি বেনারকে বলেন, “আমি ওয়াজ মাহফিলে এমন কিছু বলিনি, যা বাংলাদেশের মূল্যবোধ বিরোধী। আমার মনে হয়, সংবিধানে বাকস্বাধীনতার যে অধিকার, তা—ই হরণের চেষ্টা চলছে।”

ওয়াজ–মাহফিলে যাঁরা বক্তব্য রাখেন তাঁদের সিংহভাগ কওমী মাদরাসার ছাত্র। বাংলাদেশে কওমী মাদরাসাগুলোর সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল ইসলাম ইসলামাবাদী সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন এটি কণ্ঠরোধের চেষ্টা।

“ওয়াজ–মাহফিলে ভালো কথা বলা হয়, ধর্মের কথা বলা হয়। সেখানে নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা হচ্ছে। মাঝে মাঝে দু’একজন হয়তো কথার ফাঁকে কিছু বলতে পারেন। তাই বলে তাঁদের কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া কিছুতেই উচিত নয়,” আজিজুল ইসলাম ইসলামাবাদী বেনারকে বলেন।

কারা শনাক্ত, কেন

সূত্র বলছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। প্রতিবছর শীত মৌসুমে আলেম-ওলামারা ওয়াজ মাহফিল করেন। তাঁদের বক্তব্য, ফেসবুক ইউটিউবে প্রচারিত হয়। বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যের কারণে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা উগ্রবাদে দীক্ষিত হতে পারেন।

মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে যে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁরা হলেন আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসূফ, মাওলানা মুফতি মাহমুদুল হাসান (মুহতামিম, জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া, মোহাম্মদপুর), আল্লামা মামুনুল হক (যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস), মুফতি ইলিয়াছুর রহমান জিহাদী (প্রিন্সিপাল, বাইতুল রসূল ক্যাডেট মাদ্রাসা ও এতিমখানা, ক্যান্টনমেন্ট), মুফতি ফয়জুল করিম (জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির, ইসলামী আন্দোলন), মুজাফফর বিন মুহসিন, মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন (যুগ্ম মহাসচিব, ইসলামী ঐক্যজোট), মতিউর রহমান মাদানী, মাওলানা আমীর হামজা, মাওলানা সিফাত হাসান, দেওয়ানবাগী পীর, মাওলানা আরিফ বিল্লাহ, হাফেজ মাওলানা ফয়সাল আহমদ হেলাল ও মোহাম্মদ রাক্বিব ইবনে সিরাজ।

প্রতিবেদনে বক্তাদের বিভিন্ন সময় মাহফিলে দেওয়া বক্তব্যের ভিডিও লিংক রয়েছে।

ওই লিঙ্কগুলোয় আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসূফকে মূর্তি ভাঙার বিষয়ে, মোহাম্মদপুর জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বললে হত্যার হুমকি দিতে এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হককে কওমী মাদরাসায় কেন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া অনুচিৎ তার পক্ষে যুক্তি দিতে শোনা গেছে।

তাছাড়া, ইসলামী ঐক্যজোটের সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন মিয়ানমারের বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুসলমানদের ওপর জিহাদ ফরজ কেন সে সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন। কাদিয়ানী প্রসঙ্গে তাঁর বয়ানের লিঙ্কও দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশের অনলাইন নিউজ পোর্টালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাখাওয়াৎ হোসাইন দাবি করেন, তিনি সবসময় জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ওয়াজ মাহফিলে কথা বলে আসছেন।

তিনি বলেন, “দেশে যখন জেএমবির উত্থান ঘটে তখন থেকেই প্রতিবাদ করে বক্তব্য রাখছি। সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে মাদকের বিরুদ্ধেও বক্তব্য রাখি ওয়াজ মাহফিলে। যারা প্রতিবেদন তৈরি করেছে তারা কি আমার এসব বক্তব্য শোনেননি?”

স্বাগত জানিয়েছেন সাংস্কৃতিক কর্মীরা

সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন কেউ কেউ। তাঁরা বলছেন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পথকে প্রশস্ত করা খুব প্রয়োজন।

উদীচীর সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন বলেন, জঙ্গিবাদ দমনে যেসব অনুষ্ঠান কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে বলা হয়ে থাকে, সেগুলোর অনুমতি পাওয়াই কঠিন। তবে ওয়াজ মাহফিলের অনুমতি মিলছে ঠিকই।

“দেখুন বাউল বা যাত্রাপালা – যেগুলো জঙ্গিবাদ দমনে কাজ করে থাকে, সেগুলোকে সন্ধ্যার পর চলতে দেওয়া হয় না। অনুমতি থাকলেও প্রশাসন অনুষ্ঠান করতে দেয় না। যাত্রা সংগঠনগুলো তো বন্ধই হয়ে গেছে,” জামসেদ বলেন।

খেলাফত আন্দোলনের প্রতিবাদ

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ওয়াজ মাহফিলে বক্তাদের ওপর নজরদারি করার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী, নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদীসহ সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।

মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তাঁরা বলেছেন, শত শত বছর ধরে এ দেশে আলেম-ওলামারা ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে জনসাধারণকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (সা.) আনুগত্যের দিকে দাওয়াত দিয়ে আসছেন।

তাঁদের মতে, কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করা ঈমানী দায়িত্ব। আল্লাহ প্রদত্ত এ মহান দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।