ধরপাকড়ের মধ্যে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে আহ্বায়ক কমিটি
2021.04.26
ঢাকা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনার ধারাবাহিকতায় ব্যাপক ধরপাকড়, মামলাসহ নানামুখী সরকারি চাপের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে পাঁচ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছে কওমি মাদ্রাসা-ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
সহিংস ঘটনাগুলোর পর থেকে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল, দলটির নেতারা সেই চাপ সামলাতে পারেননি বলে মত দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি দল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সোমবার এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেছেন, “শুধু (কমিটি) বিলুপ্ত করলেই হবে না। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার রাজনীতিও বিলুপ্ত করতে হবে।”
এর আগে মোদিবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যারা সহিংসতায় অংশ নিয়েছে তাঁদের গ্রেপ্তারের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন ওবায়দুল কাদের ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
“যারা সহিংসতা করেছে, যারা সহিংসতা করতে বলেছে এবং উৎসাহ দিয়েছে তথ্যপ্রমাণসাপেক্ষে তাঁদের ধরা হচ্ছে। হেফাজতের নেতা হিসেবে কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না,” বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
হেফাজতের সদ্যবিলুপ্ত কমিটির প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান বেনারকে জানান, “গত দুই সপ্তাহের মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় ১৮ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া গ্রেপ্তার হওয়া কর্মীর সংখ্যা কয়েকশ।”
“গ্রেপ্তার ও মামলার ভয়ে হেফাজত নেতা-কর্মীরা বড়ো ধরনের চাপের মধ্যে আছে, যা পরিষ্কার। আর সরকারের নানামুখী চাপ কমাতেই কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নিকট আত্মীয়দের দিয়ে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছেন জুনায়েদ বাবুনগরী,” বেনারকে বলেন লেখক ও গবেষক আফসান চৌধুরী।
রোববার রাত এগারোটায় ফেসবুক লাইভে সংগঠনটির আমির মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী জানান, “দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে” সংগঠনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে তিনি হেফাজতে ইসলামে কেন্দ্রীয় এবং মহানগর কমিটি ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এর আগে গত কয়েকদিন ধরে বাবুনগরী একের পর এক ভিডিও কনফারেন্সে মামলা, গ্রেপ্তার বন্ধ করতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে আসছিলেন।
আফসান চৌধুরীর মতে, দেশের ‘সার্বিক পরিস্থিতি’ বলতে বাবুনগরী বোঝাতে চেয়েছেন, “আসলে তিনি বিপদে আছেন। কারণ দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ বেশ কমেছে।”
এদিকে কমিটি বিলুপ্ত করার আগেই রোববার কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা পরিচালনাকারী সংস্থা আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ জানায়, কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকেরা প্রচলিত সব ধরনের রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকবেন।
কেন্দ্রীয় কমিটি বাতিল সংক্রান্ত হেফাজতের প্রেস বিজ্ঞপ্তি বেনারের কাছে রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, “একটি আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে, ইনশাল্লাহ।”
পরে আরেক বিবৃতিতে জানানো হয়, পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির প্রধান হলেন জুনায়েদ বাবুনগরীর মামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। অন্য সদস্যরা হলেন; জুনায়েদ বাবুনগরী, নুরুল ইসলাম, সালাহ উদ্দীন নানুপুরী ও পীর মিজানুর রহমান।
হেফাজত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্চে স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরকারি হিসেবে মারা গেছেন ১৮ জন।
এ ছাড়া পুলিশের ওপর আক্রমণ হয়েছে, বিভিন্ন থানায় হামলা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় সরকার ও জনগণের বিপুল সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান সোমবার বেনারকে বলেন, শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাতেই ৫৫টি মামলার বিপরীতে এ পর্যন্ত ৩৬৯ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এর বড়ো অংশ হেফাজতের নেতাকর্মী।
চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের তথ্যমতে, মোদির সফরকেন্দ্রিক ২৬-২৭ মার্চের সহিংসতায় বিভিন্ন জেলায় মোট মামলা হয়েছে ৮৭ টি, গ্রেপ্তার হয়েছেন পাঁচ শতাধিক, যাদের বেশিরভাগই হেফাজতের নেতা-কর্মী।
২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বর ঘেরাও করে ব্যাপক সহিংসতার পাশাপাশি সরকার পতনের ডাক দিয়েছিল হেফাজত। ওই ঘটনায় ৮৩টি মামলা হয়, যেগুলোর একটিরও বিচার হয়নি।
তবে নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে আবার সহিংস ঘটনায় জড়ালে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের মামলাগুলো সচল করা হয়, গ্রেপ্তার হন বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।
হেফাজতের প্রধান জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে কমপক্ষে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া, হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ শফীর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা একটি মামলারও আসামি বাবুনগরী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু খালেদ মোহাম্মদ খাদেমুল হক বেনারকে বলেন, “বলা হয়, হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন, আসলে এটি একটি ধাপ্পাবাজি। তাদের সকল কর্মকাণ্ডই রাজনৈতিক। ২০১৩ সালের সহিংস আন্দোলনের পর হেফাজতকে আর অরাজনৈতিক সংগঠন বলা যায় না।”
তাঁর মতে, “ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া সহিংসতা এবং তার আগে-পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ভাঙচুরের ঘটনা সরকারকে ক্ষিপ্ত করে তোলে।”
“পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পেরে হেফাজত নেতারা সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করলেও সরকার কঠোর অবস্থানেই আছে,” বলেন খাদেমুল হক।
“হেফাজতের নেতাদের শায়েস্তা করতে ২০১৩ সালের মামলাগুলো চালু করেছে সরকার, নতুন মামলাও দিচ্ছে। কারণ সরকার মনে করছে, হেফাজত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, এখনই লাগাম টেনে ধরা সময়,” বলেন আফসান চৌধুরী।
তাঁর মতে, “হেফাজতের নেতাদের এই গ্রেপ্তার চলতেই থাকবে। তা ছাড়া সরকার চায় প্রয়াত আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানী হেফাজতের নেতৃত্বে আসুক। কারণ আনাস সরকার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।”
মামুনুল ফের রিমান্ডে
হেফাজতের সদ্যবিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হককে ২০২০ সালের একটি মারামারি ও চুরির মামলায় গত ১৯ এপ্রিল সাত দিনের পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল
আজ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ২৬ মার্চের ঘটনায় দায়ের করা মামলা ও ২০১৩ সালের আরেকটি মামলায় আদালত মামুনুলের সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে বলে বেনারকে জানান মামুনুল হকের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন মেসবাহ।
ওই আইনজীবী বলেন, মামুনুল হকের নামে মোট ২৩টি মামলার কাগজ আমি হাতে পেয়েছি।
রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে তেজগাঁও জোনের উপকমিশনার হারুনুর রশীদ সাংবাদিকদের জানান, রিমান্ডে মামুনুল হক বলেছেন, তিনি ১৫ বছর আগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পরিকল্পনা করেন। এ ছাড়া তিনি পাকিস্তান গিয়ে জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
তবে জয়নুল আবেদীন বলেন, মামুনুল হক জঙ্গি কার্যক্রমের সাথে যুক্ত-এমন কাগজপত্র পুলিশ আদালতে দাখিল করতে পারেনি। তা ছাড়া আইন অনুযায়ী কোনো আসামির বিরুদ্ধে চলমান তদন্তের ব্যাপারে পুলিশ কাউকে এভাবে বলতে পারে না।