কুমিল্লায় পূজা মণ্ডপে কোরান পাওয়ার ঘটনায় সংঘর্ষ
2021.10.13
ঢাকা
আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২১। ইস্টার্ন সময় বিকেল ০৫:৩০
কুমিল্লার একটি পূজা মণ্ডপে মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরান উদ্ধারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বুধবার উত্তেজিত মুসল্লিরা সেখানকার অন্তত ১৯টি পূজামণ্ডপে হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংখ্যালঘু নেতারা। এ ঘটনার পর জেলার মোট ৭৫১টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপন বন্ধ রয়েছে বলেও তাঁরা বেনারকে জানিয়েছেন।
“আক্রান্ত ১৭টি পূজামণ্ডপই শহরের,” জানিয়ে কুমিল্লা জেলার পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল পাল বুধবার রাত ১১টায় বেনারকে জানান, এর বাইরে সদর দক্ষিণ উপজেলার একটি মন্দির এবং লাঙ্গলকোটের আরেকটি মণ্ডপ ভাংচুরের শিকার হয়েছে।
তবে “আপাতত সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, উত্তেজিত মুসল্লিদের কেউই এখন আর মাঠে নেই,” বলে রাত আটটার দিকে বেনারকে জানিয়েছিলেন জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ফারুক আহমেদ।
সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কুমিল্লা শহরে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করার কথা উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
তবে নির্মল পাল বেনারকে জানান, “পুরো শহরের পরিস্থিতিই এখন পর্যন্ত থমথমে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও পুলিশ টহল দিলেও আমাদের (হিন্দুদের) নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই।”
কুমিল্লা শহরের এই পরিস্থিতিকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ উল্লেখ করে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও চান্দিনার উপজেলা চেয়ারম্যান বাবু তপন বকসি বেনারকে জানান, শহরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার মণ্ডপগুলোতে পূজা উদযাপনের সার্বিক কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ‘সাম্প্রদায়িক’ ও ‘স্পর্শকাতর’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “প্রশাসনের সক্রিয় হস্তক্ষেপেই আমাদের ভরসা। আপাতত পূজা বন্ধ রেখে আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।”
সংখ্যালঘু নেতাদের দাবি, কুমিল্লা শহরজুড়ে যারা পূজাবিরোধী বিক্ষোভ করেছে, তারাই হিন্দুদের এই উৎসবটি বানচালের উদ্দেশ্য পরিকল্পিতভাবে নানুয়া দিঘীর উত্তর পাড়ে দর্পণ সংঘের মণ্ডপে কোরান রেখে গেছে। সকালে সেখানে কোরান রাখার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ গিয়ে তা উদ্ধার করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন খবর প্রচারের পরপরই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসার আলেম-ইমামদের নেতৃত্বে মুসুল্লিরা বিক্ষোভ শুরু করেন।
একাধিক মণ্ডপের সামনে তাদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। দুই পক্ষই কয়েকজন আহত ও গ্রেপ্তার হওয়ার দাবি তুললেও এসপি ফারুকের দাবি, সেখানে কেউ আহত হয়নি। কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।
উত্তেজিত মুসল্লিদের শান্ত করার লক্ষ্যে বিকেল পাঁচটার দিকে কুমিল্লা শহরের কমপক্ষে ৭০ জন আলেম-ইমামের সাথে বৈঠকে বসে জেলা প্রশাসন। ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া কালেক্টরেট জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল মতিন বেনারকে জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় আহত মুসল্লিদের চিকিৎসা এবং পুলিশের হাতে আটক প্রতিবাদকারীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
“বেশ কয়েকজন কয়েকজন আহত এবং আটক হয়েছে, সঠিক সংখ্যা জানি না,” বলেন মাওলানা মতিন।
বৈঠকে জেলার এসপি মুঠোফোনে যুক্ত হয়েছিলেন উল্লেখ করে এই ইমাম বলেন, “আগামী শুক্রবার বাদ জুমা কেউ যাতে কোনো বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ না করে, সে ব্যাপারে তিনি বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন। যে ঘটনা ঘটছে তা সঠিকভাবে তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনারও আশ্বাস দিয়েছেন।”
বিকেল থেকে কুমিল্লায় মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক সমস্যা করছে বলেও বেনারকে জানিয়েছেন সেখানকার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতারা।
ধর্মমন্ত্রীর জরুরি বার্তা
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক এক জরুরি ভিডিও বার্তায় বুধবার বলেছেন, “ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে যে বা যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকুক, তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।”
“তবে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ আইন হাতে তুলে নেবেন না। সবাইকে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অনুরোধ করা হলো,” যোগ করেন তিনি।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও ঢাকার সাংবাদিকদের বলেছেন, “কুমিল্লার ঘটনায় যারাই জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে, কেউ ছাড় পাবে না।”
ঐক্য পরিষদের বিবৃতি
“শারদীয় দুর্গোৎসবকে বানচাল করে গোটা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে কুমিল্লায় এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে,” বেনারকে বলেছেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে বড়ো সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে বুধবার রাতেই পরিষদের নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে দেখা করেছেন বলেও জানান মনীন্দ্রনাথ।
এর আগে এক বিবৃতিতে পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতারা দাবি করেছেন, সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্সের ঘোষণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে এই হামলার ঘটনা।
কুমিল্লার ঘটনার সাথে যারা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের সবাইকে অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবিও জানিয়েছেন পরিষদের সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক ও নির্মল রোজারিও এবং সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত।
সোচ্চার ইসলামি দলগুলো
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মহাসচিব প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান এক বিবৃতিতে এই ঘটনাকে ‘ধর্মীয় দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধানোর চক্রান্ত’ আখ্যা দিয়েছেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুমও পৃথক বিবৃতিতে বলেন, “একটি বিশেষ মহল বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানছে।”
এই দুটি বিবৃতিতে জড়িতদের শাস্তি দাবি করা হয়েছে।
উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে অন্য জেলাতেও
কুমিল্লার ঘটনার জেরে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন পূজামণ্ডপও হামলার শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এসময় পুলিশের সাথে হামলাকারীদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।
সংঘর্ষে “অনেকেই আহত হয়েছেন,” জানিয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোমেনা আক্তার বেনারকে বলেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাত ১১টায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।”
সংঘর্ষে “পাঁচ-ছয়জন” গুরুতর আহত হয়েছেন জানিয়ে হাজীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ বেনারকে জানান, ১৭-১৮ জন পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন।
এর বাইরে বুধবার দিবাগত রাতে সিলেটের জকিগঞ্জ, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, নোয়াখালীর হাতিয়া ও কক্সবাজারের পেকুয়ার বিভিন্ন মণ্ডপ-মন্দিরে হামলার হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন হিন্দুদের একাধিক সংগঠনের নেতারা।