ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত: তিনটি পৃথক মামলা করেছেন এক আইনজীবী

শরীফ খিয়াম
2021.11.02
ঢাকা
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত: তিনটি পৃথক মামলা করেছেন এক আইনজীবী সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আয়োজিত সহিংসতা বিরোধী কনসার্টে মেঘদলের গান শুনছেন দর্শকরা। ২২ অক্টোবর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে একের পর এক মামলা দায়ের করা ঢাকার আইনজীবী ইমরুল হাসানের বার কাউন্সিল সনদ বাতিলের দাবি তুলেছেন ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল নাগরিক ও সাংস্কৃতিকজনেরা। তাঁদের মতে,

এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইমরুল ধারাবাহিকভাবে ‘সাম্প্রদায়িক উস্কানি’ দিয়ে যাচ্ছেন।

গত বছর পালাগানের জনপ্রিয় শিল্পী রিতা দেওয়ান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়াউর রহমান জিয়ার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেন এই আইনজীবী।

সর্বশেষ গত ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড মেঘদলের সাত সদস্যের বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে মামলা দায়ের করেছেন তিনি।

ইমরুল যেভাবে একের পর এক মামলা দায়ের করছেন, “সেটা মোটেই সুস্থ কোনো চর্চা নয়,” জানিয়ে শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ও ছড়াকার রবীন আহসান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি ধারাবাহিকভাবে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে যাচ্ছেন।”

এর প্রেক্ষিতেই তিনি ইমরুলের আইনজীবী সনদ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বলে জানান রবীন।

“দেশের গান, বাউল গান ও সংস্কৃতি বাঁচাতে ইমরুল হাসানের আইনজীবী সনদ বাতিল’ করা হোক,” ফেসবুকে এক পোস্টে দাবি করেন রবীন।

এই দাবি আদায়ে প্রয়োজনে রাজপথে আন্দোলন করার কথাও জানিয়েছেন প্রগতিশীল নাগরিক মোর্চা নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগের অন্যতম এই সংগঠক।

তিনি বলেন, “মামলাটির কারণে মেঘদলের সদস্যদের কোনো হয়রানি করা হলে আমরা ওই আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করার দাবি জানাব।”

দেশের শিল্প-সাহিত্য ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের আরো অনেকেই ফেসবুকে ‘স্ট্যান্ড উইথ মেঘদল’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে ব্যান্ড দলটির বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

মেঘদলের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ঘটনায় আগামী বৃহস্পতিবার বিকেলে শাহবাগে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে বামপন্থী সংগঠন সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন।

তবে এসবে পরোয়া করছেন না ইমরুল। তিনি বেনারকে বলেন, “আমি কোনো চাপে নেই। এটি একটি মুসলিম দেশ। এখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলা করে আমি কেন চাপে থাকব?”

নতুন মামলাটি নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য দেবেন না জানিয়ে ইমরুল বেনারকে বলেন, “এ জাতীয় মামলা আগেও করেছি। রিতা দেওয়ান ও ড. জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদীও আমি নিজেই।”

তবে মামলা দায়ের করার দায়ে “কারো বার কাউন্সিল সনদ বাতিলের সুযোগ নেই,” বলে বেনারকে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক ব্যারিস্টার আরাফাত হোসেন খান।

এছাড়া সনদ বাতিল হলেও ইমরুল এমন মামলা করতে পারবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এই অধিকার তাঁর রয়েছে।”

“শুধু শিষ্টাচার বহির্ভূত অনৈতিক আচরণের জন্য” আইনজীবীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত ও বিচার করে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা বার কাউন্সিলের রয়েছে বলে জানান তিনি।

পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ

মেঘদলের সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার আবেদনের শুনানি শেষে রোববার ঢাকা মহানগর হাকিম বিষয়টি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়ে আগামী ১ ডিসেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।

গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ইমরুলের দায়ের করা মামলায় বাউল রিতাসহ দুই ইউটিউবারের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত সংস্থা পিবিআই।

তারা প্রতিবেদন দেওয়ার প্রায় এক বছর পর গত ২৫ অক্টোবর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু করেছে।

এই ট্রাইব্যুনালে গত বছরের ২৫ অক্টোবর ড. জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় আদালত তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে বলেও জানান ইমরুল।

তিনি জানান, জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুটি মামলা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশন তদন্ত করছে।

ইমরুলের অভিযোগ অনুযায়ী, রিতা পালাগানের আসরে ‘আল্লাহ’ সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন এবং ড. জিয়া একটি বেসরকারি টেলিভিশনে ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছিলেন।

একজন আইনজীবী হিসেবে ইমরুলের যেমন “যেকোনো বিষয়ে মামলা করার অধিকার রয়েছে,” তেমনি প্রত্যেক শিল্পীরও “নিজের মতামত রাখার স্বাধীনতা আছে,” বলে মনে করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস।

তবে তাঁর মতে, এ জাতীয় মামলা “অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেওয়া এই রাষ্ট্রের সংবিধানের মূল চেতনা-ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী।”

যে কারণে এই মামলা

সাম্প্রতিক সময়ের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ২২ অক্টোবর আয়োজিত ‘সহিংসতা বিরোধী কনসার্ট’-এ ২০০৫ সালে প্রকাশিত ‘দ্রোহের মন্ত্রে ভালবাসা’ সংকলনের ‘ওমশিরোনামের গানটি পরিবেশন করে মেঘদল।

ওই গানের কথায় ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ‘কালেমা’-র (মৌলিক বিশ্বাস সংবলিত আরবি পঙক্তি) অংশবিশেষ ও হজে আবশ্যকীয় ‘তালবিয়া’ (বিশুদ্ধ মিনতি প্রক্রিয়া) ব্যবহারের জন্য ব্যান্ডটির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সেদিন রাত থেকেই ফেসবুকে ‘হেইট ক্যাম্পেইন’ শুরু হয়।

এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক শুরু হওয়ায় পরদিন নিজেদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ নিষ্ক্রিয় করে দেয় মেঘদল।

এরই ধারাবাহিকতায় দায়ের করা মামলার অভিযোগে ইমরুল জানান, ২৬ অক্টোবর নিজের বাসায় ইউটিউবে তিনি গানটি দেখেছেন।

হজের ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিকে ইসলামে নিষিদ্ধ বাদ্য বাজনার সাথে গান আকারে অশ্রদ্ধার সঙ্গে গাওয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “মুসলমানদের পবিত্র কালিমার অংশও গানের তালে পাঠ করা হয়।

এ কারণে গানটি ধর্মানুভূতিতে আঘাত হেনেছে অভিযোগ করে ইমরুল আরো জানান, তিনি প্রথমে কদমতলী থানায় মামলা করতে যান। থানা কর্তৃপক্ষ মামলা গ্রহণ না করে তাঁকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেন।

মামলায় মেঘদলের গায়ক শিবু কুমার শীল, মেজবাউর রহমান সুমন, গিটারবাদক ও গায়ক রাশিদ শরীফ শোয়েব, বেজ গিটারবাদক এম জি কিবরিয়া, ড্রামবাদক আমজাদ হোসেন, কিবোর্ডবাদক তানভির দাউদ রনি এবং বংশীবাদক সৌরভ সরকারকে আসামি করা হয়েছে

গানটি নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্ক ও ইমরুলের দায়ের করা মামলার ব্যাপারে মেঘদলের সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে চাইছেন না। “আমাদের বক্তব্য দেওয়ার মতো কিছু নেই এখন,” বেনারকে বলেন মেঘদলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।