বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় মাদ্রাসার চার ছাত্র–শিক্ষক কারাগারে

শরীফ খিয়াম
2020.12.07
ঢাকা
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় মাদ্রাসার চার ছাত্র–শিক্ষক কারাগারে কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর এই ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলে দুর্বৃত্তরা। ৫ ডিসেম্বর ২০২০।
[বেনারনিউজ]

কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুরের মামলায় দুই মাদ্রাসা ছাত্র ও দুই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

“সোমবার কুষ্টিয়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আসামিদের হাজির করে পুলিশ রিমান্ড চায়। আদালত মঙ্গলবার শুনানির দিন ধার্য করে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন,” সাংবাদিকদের জানান কুষ্টিয়া মডেল থানার পরিদর্শক নিশিকান্ত দাস। 

হেফাজতে ইসলামসহ কিছু সংগঠন নভেম্বর থেকে ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে আসছে। এরই মধ্যে শুক্রবার রাতে কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ​সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণকৃত এই ভাঙচুরের দৃশ্য মূল ধারার কিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

শনিবার রাতে কুষ্টিয়া পৌরসভার সচিব কামাল উদ্দীন বাদী হয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা করেন। ওই রাতে অভিযান চালিয়ে শহরের একটি মাদ্রাসার দুই ছাত্র এবং দুই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন; শহরের জগতি পশ্চিমপাড়া এলাকার ইবনি মাসউদ (রা.) মাদ্রাসার শিক্ষক মো. আল আমিন (২৭) ও মো. ইফসুফ আলী (২৬) এবং একই মাদ্রাসার হেফজ বিভাগে অধ্যয়নরত ছাত্র মো. আবু বক্কর ওরফে মিঠুন (১৯) ও মো. সবুজ ইসলাম ওরফে নাহিদ (২০)। 

রোববার কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার মুহিদ উদ্দীন জানান, “হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের নেতা মাওলানা মামুনুল হক ও সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের বয়ানে উদ্বুদ্ধ হয়ে আবু বক্কর ও সবুজ ইসলাম বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুর করেছেন।” 

KU_02.jpg
নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য ভাঙার দায়ে চারজনকে গ্রেপ্তারের পর কুষ্টিয়ার আদালতে হাজির করে পুলিশ। ৭ ডিসেম্বর ২০২০। [বেনারনিউজ]

হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য-বিরোধী বক্তব্য দেওয়ার কারণে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির জুনাইদ বাবুনগরী, যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির সৈয়দ ফয়জুল করীমের বিরুদ্ধে আদালতে পৃথক দুটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়েছে। 

মামলা দুটি তদন্তের দায়ভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দিয়ে ৭ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

ফয়জুলকে একটি এবং মামুনুলকে দুটি মামলাতেই অভিযুক্ত করা হয়েছে। 

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল এবং বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট মশিউর মালেক মামলা দুটি দায়ের করেন। অভিযুক্তরা ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন বলেও মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়। 

এর প্রতিক্রিয়ায় হেফাজতের নায়েবে আমির ড. আহমাদ আবদুল কাদের বেনারকে বলেন, “এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ইসলামী শরিয়তের পক্ষে কথা বললে কেউ যদি রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে যায়, তাহলে তো আলেমদের কিছু বলারই সুযোগ থাকবে না। এটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের আসল চেহারা জনগণের সামনে পরিষ্কার হচ্ছে।” 

মামলায় অভিযুক্ত মামুনুল বেনারকে বলেন, “আমরা এমন কোনো কাজ করিনি বা এমন কোনো কথা বলিনি যেটা বাংলাদেশ রাষ্ট্র বা দেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। সম্পূর্ণ মনগড়াভাবে আমাদের বিরুদ্ধে একটা মতবাদ দাঁড় করিয়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে।” 

কুষ্টিয়ার ভাস্কর্য ভাঙার সাথে নিজেদের কোনো যোগসূত্র নেই বলে দাবি করেন মামুনুল। 

ধর্মের আজগুবি ব্যাখার অভিযোগ

বাদী আমিনুলের মামলার আর্জিতে বলা হয়েছে, “আসামিরা ধর্মের আজগুবি ব্যাখ্যা দিয়ে বিদ্বেষপূর্ণ, কাল্পনিক, উত্তেজনাকর ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। তারা বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও সংবিধান সম্পর্কে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন।” 

“মামুনুল হক ঢাকার বিএমএ মিলনায়তনে এক আলোচনাসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকি দেন, যা দেশ ও সরকারের স্থিতিশীলতাকে ‘হুমকির মুখে’ ফেলে দিয়েছে,” উল্লেখ রয়েছে বাদী মশিউরের আবেদনে। 

তবে মামুনুল বেনারকে বলেন, “আমাদের দ্বিমত বা ভিন্নমত শুধু ভাস্কর্য এবং মূর্তির সঙ্গে। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর, বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং সংবিধানের প্রতি আমাদের পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে। এটাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে বঙ্গবন্ধুর সম্মান পুঁজি করে একটা চেতনার ব্যবসা করার চেষ্টা করছে তারা (মামলাকারীরা)।” 

“ভাস্কর্য বা মূর্তির বিরোধিতাকে যারা বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা বা, রাষ্ট্রদ্রোহীতা প্রমাণের চেষ্টা করছে, তারা অপরাধী,” দাবি করেন ড. কাদের। 

বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল রক্ষার নির্দেশনা

চলমান পরিস্থিতিতে সারা দেশে থাকা জাতির পিতার বিদ্যমান ও নির্মাণাধীন ম্যুরালগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে সোমবার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। 

অপর একটি বেঞ্চে দেশের সব ভাস্কর্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদনের ওপর শুনানি হবে মঙ্গলবার। 

৭ মার্চকে জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণা করা সংক্রান্ত একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট প্রতিটি জেলা ও উপজেলা সদর দপ্তরে জাতির পিতার ম্যুরাল স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

রিটের পক্ষে শুনানি করা আইনজীবী বশির আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনার কারণে ম্যুরালগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়ার আরজি জানিয়েছিলেন তিনি। 

এরই প্রেক্ষিতে সোমবার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দীনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ জাতির পিতার বিদ্যমান ও নির্মাণাধীন ম্যুরালে নিরাপত্তা নিশ্চিতের নির্দেশ দেন। 

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে ৩৮০টি উপজেলা ও ৬৩টি জেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স স্থাপন করে কমপ্লেক্সের সামনে জাতির পিতার ম্যুরাল স্থাপন করেছে। 

কঠোর অবস্থানে সরকার

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের ওপর হামলার ধৃষ্টতা যারা দেখিয়েছে, তাদের চরম মূল্য দিতে হবে।” 

এ ঘটনার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের উসকানি আছে কিনা সেটিও সরকার খতিয়ে দেখছে বলে তিনি জানিয়েছেন। যদিও বিএনপি এর আগে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। 

আওয়ামী যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক বিপ্লব মুস্তাফিজ বেনারকে বলেন, “আমাদের এখানে মৌলবাদীদের আস্ফালন, তাদের উগ্রবাদী আচরণ বা রাজনীতিতে ধর্ম এনে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। যুবলীগ এই পরিস্থিতি চেয়ে দেখবে না।” 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনাটি শুধু আওয়ামী লীগ নয়, পুরো জাতির ওপর বড় আঘাত। নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত রাজনীতিই এর জন্য দায়ী।” 

তিনি মনে করেন, “নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা বদলের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে সমাজে এমন সামাজিক অরাজকতা তৈরি হয়। সরকারকে যে কোনো উপায়ে এটা সামাল দিতে হবে।” 

দেশের প্রধান দুটি বড় দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) পৃষ্ঠপোষকতাই চরম মৌলবাদকে ধীরে ধীরে শক্তিশালী করেছে জানিয়ে এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “ক্ষমতায় থাকার বা যাওয়ার জন্য তারা যে কোনো শক্তির সঙ্গে আঁতাত করতে পারে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।