তিন সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ পাহাড়ি নেতা মাইকেল চাকমা

শরীফ খিয়াম
2019.04.30
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
190430_Mikel_Chakma_Abducttion_1000.jpg পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নিখোঁজ নেতা মাইকেল চাকমার সন্ধান চেয়ে ঢাকায় জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের কর্মসূচি। ২৮ এপ্রিল ২০১৯।
[শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ পাহাড়ি নেতা মাইকেল চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন স্বজন ও সহযোদ্ধারা। তবে পুলিশের দাবি ‘খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাঁকে’।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মুখপাত্র মাইকেল চাকমা গত ৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় সাংগঠনিক কাজ শেষে ঢাকায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন।

এর প্রেক্ষিতে ১৫ এপ্রিল যৌথ বিবৃতি দিয়ে গণমাধ্যমকে বিষয়টি অবহিত করে ইউপিডিএফের চার সহযোগী সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, শ্রমজীবী ফ্রন্ট (ইউডব্লিউডিএফ), পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশন।

চার সংগঠনের বিবৃতিতে বলা হয়, “পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং দেশের নিপীড়িত-নির্যাতিত ও শ্রমজীবী মানুষের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে ধ্বংস করে দেয়ার রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মাইকেল চাকমাকে তুলে নেওয়া হয়েছে। সরকার এ ঘটনার দায় কিছুতেই এড়াতে পারে না।”

“ওত পেতে থাকা একটি শক্তিশালী চক্র তাঁকে অজ্ঞাত স্থানে তুলে নিয়ে যায়,” উল্লেখ করা হয় ওই বিবৃতিতে।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা বেনারকে জানান, ১৬ এপ্রিল তাঁরা বিষয়টি সোনারগাঁও থানাকে অবহিত করেন। তিন দিন পর পুলিশ অভিযোগটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে গ্রহণ করে তদন্ত শুরু করে।

সোনারগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “সর্বশেষ ঢাকার একটি এলাকায় মাইকেলের অবস্থান আন্দাজ করা যায় তাঁর কাছে থাকা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। এরপর তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি।”

মাইকেল চাকমার ‘ফোন ট্র্যাক’ প্রতিবেদন সংক্রান্ত একটি নথি বেনারের হাতে এসেছে। তাতে দেখা গেছে, ১৫ এপ্রিল ঢাকার উত্তর কাফরুল এলাকায় সর্বশেষ তাঁর মোবাইলটি খোলা হয়েছিল। এর আগে তাঁর ফোনটি শেষবারের মতো খোলা ছিল ৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায়।

তবে মাইকেলের স্বজনরা জানান, ৯ এপ্রিলের পর ফোনে না পেলেও গভীর রাতে মাইকেলেকে ‘ফেসবুক মেসেঞ্জারে’ সক্রিয় দেখতে পেয়েছেন তাঁরা। যদিও তিনি কারও বার্তার জবাব দিচ্ছেন না।

এদিকে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুনয়ন চাকমা বেনারকে বলেন, মাইকেলকে রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী আটক করতে পারে বলে পুলিশ তাঁদেরকে জানিয়েছে।

“সর্বশেষ ২৩ এপ্রিল থানায় গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাদের জানায়, মাইকেল চাকমার নামে অনেক অভিযোগ ও মামলা থাকায় রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী তাঁকে আটক করতে পারে,” বেনারকে বলেন সুনয়ন।

“সে ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে তাঁকে আদালতে পেশ করা হচ্ছে না কেন?” যোগ করেন তিনি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচসিআর) চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কোনো রকম অপরাধের সঙ্গে কারও জড়িত থাকার তথ্য থাকে, তাহলে তাঁকে তারা ‘নিতে’ পারে। কিন্তু তাঁকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে, তাঁর আইনজীবীর সাথে আলাপের সুযোগ দিতে হবে, সর্বোপরী তাঁকে কথা বলার পরিবেশ তৈরি করে দিতে। আমাদের সংবিধান এ দেশের মানুষকে এই অধিকার দিয়েছে।”

“পুলিশের দায়িত্ব মাইকেল চাকমাকে খুঁজে বের করা,” যোগ করেন তিনি।

মন্টি ও সুনয়নের দাবি, পাহাড় ও সমতলের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথার বলার জন্যই তাঁকে গুম হতে হয়েছে।

মাইকেলের সন্ধান চেয়ে ঢাকা ও পার্বত্য বিভিন্ন জেলায় কর্মসূচি পালন অব্যাহত রেখেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।

মাইকেলকে অক্ষত চায় পরিবার

এদিকে নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে জীবনে প্রথমবারের মতো ঢাকা এসেছেন মাইকেলের বোন সুভদ্রা চাকমা। তিনি সোমবার বেনারকে জানান, সরকারের কাছে মাইকেলকে অক্ষত ও সুস্থ অবস্থায় ফেরত চায় তাঁর পরিবার।

“যেভাবে নেওয়া হয়েছে, সেভাবে ফেরত চাই,” বলেন তিনি।

পাঁচ বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে মাইকেল পঞ্চম উল্লেখ করে সুভদ্রা বলেন, “যে কোনো ঘটনা ঘটলেই তা নিয়ে সরব থাকতেন মাইকেল। যে কারণে তাঁকে নিয়ে সবসময়ই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থেকেছে আমাদের পরিবার।”

উল্লেখ্য, মাইকেলের বাড়ি রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায়।

সর্বশেষ যা বলেছিলেন মাইকেল

গত ৩ এপ্রিল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দোছড়ি ইউনিয়নের মিয়ানমার সীমান্তবর্তী তুলাতলী ডলুঝিড়ি এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মূল দলের নেতা জ্ঞান শংকর চাকমা নিহত হওয়ার পর বেনারের সাথে সর্বশেষ কথা বলেছিলেন মাইকেল।

সেদিন এই ইউপিডিএফ নেতা বলেন, “জেএসএস–এর (সন্তু-লারমা গ্রুপ) একজন নেতৃস্থানীয় সংগঠক ছিলেন শংকর। আমরা যতটুকু জেনেছি, ১৫-২০ দিন আগে তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল র‍্যাব। এরপর বহু খুঁজেও তাঁর খোঁজ মেলেনি।”

যৌথ বাহিনীর অভিযানে নিহত শংকরকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়নের সাত খুনের প্রধান ‘সন্দেহভাজন’ বলে দাবি করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ১৮ মার্চের ওই হত্যাকাণ্ডে উপজেলা নির্বাচন পরিষদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী সাতজন নিহত হন।

পরের দিন বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শুরু থেকেই এসব ঘটনার জন্য আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করে আসছে আইনশৃঙ্খলা ও যৌথ বাহিনীগুলো।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।