বাংলাদেশে রেলের উন্নয়নে এবার এগিয়ে এল যুক্তরাষ্ট্র

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.10.07
ঢাকা
বাংলাদেশে রেলের উন্নয়নে এবার  এগিয়ে এল যুক্তরাষ্ট্র1000 মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর. মিলার এবং বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মহিবুল হক দুই দেশের বিমান চলাচল চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০।
ছবি: ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস

বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে ষাটের দশকের পর এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ৭০টি লোকোমোটিভ সরবরাহ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার।

রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মার্কিন প্রতিষ্ঠানের রেল ইঞ্জিন বিশ্বখ্যাত। তাই এসব লোকোমোটিভ বাংলাদেশ রেলওয়ের সেবার মান বাড়াতে অবদান রাখবে।

লোকোমোটিভ সরবরাহের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য রেলওয়ের ডিজাইন উন্নয়ন ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করবে মার্কিন প্রতিষ্ঠান প্রোগ্রেস রেল। এতে ব্যয় হবে ২৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

৩০ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি কিথ ক্র্যাথ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সভার যৌথ বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমেরিকা অনুবিভাগের মহাপরিচালক শাহরিয়ার ফেরদৌসী বেনারকে বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ও আমেরিকার মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে এ ধরনের সভা হয়েছে।

তিনি বলেন, “এই সভার মূল উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা। বাংলাদেশকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।”

রেলের উন্নয়ন ঘটবে

বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. মিয়াজাহান বেনারকে বলেন, ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য ৪০টি ইঞ্জিন বিক্রি করে আমেরিকার জেনারেল মোটরস।

তিনি জানান, এরপর বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য আমেরিকান লোকোমোটিভ আনা হয়নি।

মিয়াজাহান বলেন, ওই ৪০টি ইঞ্জিনের মধ্যে এখনও তিনটি ব্যবহার করা হচ্ছে, যদিও মাঝেমধ্যে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়।

তিনি বলেন, আমেরিকার রেল ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক ক্যাটারপিলার থেকে বাংলাদেশের জন্য ৭০টি মিটার গেজ ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে। এই ইঞ্জিনগুলোকে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বলা হয়।

মিয়াজাহান বলেন, ভারত ও চীন রেলের মূল ইঞ্জিন ক্যাটারপিলারের কাছ থেকে কিনে বাকি যন্ত্রাংশ নিজেরা তৈরি করে। এরপর রেলের লোকোমোটিভ তৈরি হয়।

তিনি বলেন, “আমেরিকা থেকে যে ৭০টি মিটার গেজ ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে সেগুলো সংযোজনের জন্য প্রথমে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠানো হবে। সেখান থেকে বাংলাদেশে আনা হবে। ইতোমধ্যে দশটি লোকোমোটিভ সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে কোরিয়া।”

মিয়াজাহান বলেন, “বাকি ৬০টি লোকোমোটিভ আগামী বছর মার্চ থেকে বাংলাদেশে আসা শুরু হবে। সেগুলো আসলে বাংলাদেশ রেলওয়ের সেবার মান আরও বৃদ্ধি পাবে।”

সরকারি হিসেবে, বাংলাদেশ রেলওয়ের মোট ২৬৫টি লোকোমোটিভ আছে। এগুলোর মধ্যে ১৭১টি মিটার গেজ এবং ৯৪টি ব্রডগেজ।

মিয়াজাহান বলেন, “বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি লোকোমোটিভের অর্থনৈতিক আয়ু ২০ বছর ধরে হিসাব করে। এই ২৬৫টি লোকোমোটিভের মধ্যে কমপক্ষে শতকরা ৪০ ভাগ লোকোমোটিভের আয়ু শেষ হয়েছে। সুতরাং, আমেরিকা থেকে লোকোমোটিভ বহরে যোগ হলে রেলওয়ের সেবার মান বৃদ্ধি পাবে।”

বাংলাদেশে বর্তমানে তিন হাজার ১৮ কিলোমিটারের বেশি রেল লাইন রয়েছে। এর মধ্যে ১,৬৫২ কিলোমিটার মিটার মিটারগেজ, ৮৩১ কিলোমিটার ব্রডগেজ এবং ৫৩৫ কিলোমিটারের বেশি ডুয়েলগেজ। প্রতিদিন ৩৫৭টি যাত্রীবাহী ও ৩০টি পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে মূলত ভারতীয়, জার্মান, কানাডা, হাঙ্গেরিসহ কয়েকটি দেশের লোকোমোটিভ রয়েছে।

২০১৯ সালে নয় কোটি ২৭ লাখ যাত্রী পরিবহন করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল নয় কোটির কিছু বেশি।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে অবহেলিত ছিল বলা যায়। প্রতিটি সরকার সড়কপথে নজর দেয়ায় ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই খাতে তেমন উন্নতি হয়নি।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর রেলওয়ে সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।

তার অংশ হিসাবে নতুন নতুন লোকোমোটিভ ও কোচ ক্রয়ের পাশাপাশি ভারতের সাথে পরিত্যক্ত রেলসংযোগ পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে।

ভারত সরকারের অর্থায়নে আঞ্চলিক সংযোগের জন্য আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ বাস্তবায়ন চলছে। চিলাহাটি-হলদিবাড়ী, কুলাউড়া-শাহবাজপুর, ফেনীর বিলোনিয়া দিয়ে ভারতের সাথে রেল সংযোগ পুন:স্থাপন করে আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুনধুম পর্যন্ত রেল সম্প্রসারণ কাজ চলমান।

বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আরিফুজ্জামান বেনারকে বলেন, আমেরিকান প্রগ্রেস রেল আমাদের রেলওয়েকে ডিজাইন উন্নয়ন ও অন্যান্য সেবা দিচ্ছে।

তিনি জানান, বছরখানেক আগে রেলমন্ত্রী ও রেলের মহাপরিচালক আমেরিকা সফরে যান। সেখানে বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য আলোচনা হয়।

আরিফুজ্জামান বলেন, “আঞ্চলিক যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের সম্প্রসারণের কাজ চলমান। তবে আমাদের আরও উন্নয়ন প্রয়োজন। আমাদের রেল ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে পরামর্শ প্রয়োজন। প্রগ্রেস রেল আমাদের সহায়তা করতে পারে।”

অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ

বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত জোট বেঁধেছে। বঙ্গোপসাগরের প্রধান দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ এই জোটের কাছে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ।

বেসরকারি থিঙ্কট্যাঙ্ক পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ. মনসুর বেনারকে বলেন, বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহের কারণ হলো চীনকে ঠেকানো। আর এর ফলে বাংলাদেশের সামনে সুযোগ এসেছে।

তিনি বলেন, “আমাদের উচিত তাদের এই আগ্রহটিকে নিজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজে লাগানো। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হলো, সবার সাথে বন্ধুত্ব; কারও সাথে বৈরিতা নয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।