শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার এক সাক্ষীর রহস্যজনক মৃত্যু
2018.06.14
ঢাকা
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদের (৫৭) দ্বিখণ্ডিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ঢাকার খিলগাঁওয়ে শাহজাহানপুর বাগিচা এলাকার হিকমাহ আই হসপিটাল সংলগ্ন রেলপথে বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়।
লাশ উদ্ধারকারী রেলওয়ে পুলিশের ধারণা, রেলে কাটা পড়ে জাহিদের মৃত্যু হয়েছে। তবে এই মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। নিহত সুমনের স্বজনরাও দাবি করছেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
“যুদ্ধাপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ায় পর থেকেই তিনি প্রাণনাশের আতঙ্কে ছিলেন। ক্রমাগত হুমকির মুখে শাহজাহানপুর থানায় একটি জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করেছিলেন,” বেনারকে বলেন তাঁর শ্যালক কাজী মোহাম্মদ বখতিয়ার ওরফে টুইঙ্কেল।
তিনি মনে করেন, “হুমকিদাতারা জাহিদকে হত্যা করে থাকতে পারে।” বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায় আলবদর নেতা চৌধুরী মঈন উদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন জাহিদ। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর তাদের দুজনকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। মঈন যুক্তরাজ্যে এবং আশরাফ যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রয়েছেন।
এই মামলার অপর সাক্ষী তৌহিদুর রেজা নূর গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, “যুদ্ধাপরাধ মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ায় জাহিদকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।”
এর আগে যুদ্ধাপরাধ মামলার সাক্ষী সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাইয়ের লাশও এভাবে সড়কের ধারে পাওয়া গিয়েছিল। তখন সেই মৃত্যুকেও ‘হত্যাকাণ্ড’ বলে দাবি করেছিলেন বুলবুল।
এদিকে জাহিদের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়, “এটি একটি নিছক দুর্ঘটনা, না পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, সে বিষয়ে দ্রুত তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।”
জাহিদের ভায়রা এটিএম এমদাদুল হক বুলবুলের বক্তব্য, “সকাল সাড়ে নয়টার দিকে কে বা কারা তাঁকে উত্তর শাজাহানপুরের বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপরই রেললাইনের পাশে তাঁর লাশ পাওয়ার খবর শোনা যায়।”
“সুতরাং তাকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে,” উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “দুই বছর ধরে তিনি অনেকবার হুমকি পেয়েছেন বলেই আমরা এমনটা ধারণা করছি।”
আত্মহত্যা বলছে রেল পুলিশ
ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন ফারুক মজুমদার বেনারকে বলেন, “আমার ধারণা এটা আত্মহত্যা। তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।”
“জাহিদ ফারমার্স ব্যাংকের শান্তিনগর শাখার কর্মকর্তা থাকাকালীন নিজের আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছিলেন ওই ব্যাংকে রাখতে।”
“ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার পর তিনি লজ্জায় চাকরি ছেড়ে দেন। এ কারণে তিনি প্রচণ্ড চাপ ও মানসিক যন্ত্রণায় ছিলেন,” নিহতের স্বজনদের বরাত দিয়ে বলেন ওসি।
তিনি আরও জানান, শাহজাহানপুর থানা থেকে লাশ পড়ে থাকার খবর পাওয়ার পর তাঁরা সেখানে যান। ওই থানার ওসি আব্দুল মামুদ জানান, তাঁরা গিয়ে খণ্ডিত লাশ দেখেন।
প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে শাহজাহানপুর থানার ওসি আরও বলেন, “কয়েকজন বলেছেন, ওই ব্যক্তি রেল লাইন পার হওয়ার সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। এরপরই কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেন তার শরীরে ওপর দিয়ে চলে যায়।”
তবে লাশ উদ্ধারকারী রেল পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আনোয়ার হোসেন জানান, ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, “লাইনের বাইরের দিকের স্লিপারের ওপরে লম্বালম্বি লাশটি পড়ে ছিল। শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে দুই-তিন হাত দূরে ছিল।” তবে পুলিশ যাওয়ার আগে উৎসুক জনতা মাথাটা ধড়ের কাছে এনে রাখে।
আনোয়ার আরও বলেন, “আমরা ধারণা করছি, ট্রেনের চাকা তাঁর গলার ওপর দিয়ে গেছে। তবে কোন ট্রেন তা আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি।”
ঢাকা জেলা রেলওয়ে পুলিশ সুপার আশরাফুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, এটি একটি দুর্ঘটনা। তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার আগে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।”
“যেখানে লাশ পাওয়া গিয়েছে, জাহিদের বাসা থেকে হেঁটে সেখানে যেতে মাত্র আট-নয় মিনিট লাগে,” জানিয়ে টুইঙ্কেল বেনারকে জানান, জীবননাশের শঙ্কার কথা শুনে পুলিশ জাহিদকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চলাফেরারও পরামর্শ দিয়েছিল।
শাজাহানপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কুমার সাংবাদিকদের জানান, সুমন জাহিদ গত বছরের ২১ জুলাই নিজের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেছিলেন। এরপর থেকে প্রত্যেক মাসে থানার একটি টহল টিম তাঁর বাসায় যেত। সর্বশেষ গত ২৮ মে তাঁর বাসা পরিদর্শন করে আসে পুলিশ।
জাহিদের স্বজনরা বেনারকে জানান, বৃহস্পতিবার তাঁকে আজিমপুরে দাফন করা হবে।
ময়নাতদন্ত সম্পন্ন, অপমৃত্যুর মামলা
ঢাকা রেলওয়ে থানায় লাশ উদ্ধারের এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। ওসি ইয়াসিন বেনারকে বলেন, “এই মামলার অবশ্যই তদন্ত হবে। যা প্রকৃত ঘটনা বের করে আনবে।”
অন্যদিকে বিকালে মৃতদেহের ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহামুদ সাংবাদিকদের জানান, ট্রেনে কাটা পড়েই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
“আমরা লাশের ভিসেরা পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছি। সবগুলো পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে আসলে মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট হবে,” বলেন তিনি।
ডা. সোহেল বলেন, “নিহতের মাথা, পিঠ ও মুখে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এগুলো ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে হতে পারে বলে ধারণা করছি।” তবে তিনি মনে করেন, সুমনকে অজ্ঞান করে রেললাইনে ফেলে রাখাও ‘হতে পারে’।
এ ছাড়া লাশ উদ্ধারের ঘটনায় শাহজাহানপুর থানায়ও একটি জিডি করা হয়েছে।
পুরো পরিবার ছিল ‘অতি আতঙ্কে’
রাজধানীর উত্তর শাহজাহানপুর এলাকায় সপরিবারে বসবাস করতেন জাহিদ। তার সন্তানদের মধ্যে স্মরণ টিঅ্যান্ডটি কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আরেক ছেলে সুমন্দ্র আইডিয়াল স্কুলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র।
“মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার পর থেকে তাঁর স্ত্রী-সন্তানসহ পুরো পরিবারকেই অতি আতঙ্কে দিন কাটাতে হয়েছে,” বেনারকে বলেন টুইঙ্কেল।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়, “শৈশবে মাকে হারিয়ে সুমন অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টের ভেতর নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন।” সুমনের অকাল মৃত্যুতে তাঁর স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছে তারা।
ফেনীতে ১৯৬১ সালে জন্মগ্রহণকারী সুমন ব্যাংকার হিসেবে কাজ শুরুর আগে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন। ১৯৭১ সালে মা সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে যখন ঢাকার নিউ সার্কুলার রোডের বাড়ি থেকে আল বদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়, ছোট্ট সুমন তখন বাড়ির ছাদে খেলছিলেন।
পরে ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করা হয় সেলিনা পারভীনের মৃতদেহ। গতকাল শহীদ বুদ্ধিজীবীর একমাত্র সন্তানের লাশ রেল লাইনের ওপর পাওয়ার ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও বিষণ্ন বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানের মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনের দাবি জানিয়েছে।