যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফেঁসে যাচ্ছেন সাংসদ হান্নান ও তার ছেলেসহ ৮ জন

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.10.31
2016-04-29-ব্জীগস620.jpg বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের প্রবেশ পথে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।এখান থেকেই যুদ্ধাপরাধ মামলার চূড়ান্ত রায় প্রদান করা হয়। এপ্রিল ২৯, ২০১৬।
বেনার নিউজ।

জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সাংসদ এম এ হান্নানের বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। আগামী ১১ ডিসেম্বর ওই সংসদ ও তার ছেলেসহ আটজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ গঠন করা হবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত জানাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

গতকাল রোববার প্রসিকিউশনের দাখিল করা অভিযোগপত্রের শুনানি শেষে সোমবার আদেশের এই দিন ধার্য করেন তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। গত এক বছর ধরে ওই সাংসদ জেলে থাকায় জাতীয় সংসদে তার সদস্যপদ থাকবে কিনা, সেই প্রশ্ন উঠেছে।

প্রভাবশালী ও আলোচিত কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর ট্রাইব্যুনালের কাজকর্ম কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাইব্যুনাল আঞ্চলিক যুদ্ধাপরাধীদের দিকে নজর দিচ্ছিল। এরই মধ্যে একজন সাংসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত হওয়ায় আবারও আলোচনায় এসেছে ট্রাইব্যুনাল।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ব্যরিস্টার তুরিন আফরোজ বেনারকে বলেন, “তাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো হত্যা, নির্যাতন এবং অগ্নিসংযোগের মত অপরাধ করা।”

সাংসদ হান্নান সম্পর্কে তিনি বলেন, “সংসদ সদস্য নয়, মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবেই তার বিচার হবে। মামলা শুরুর পরে আমরা তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করবো। তিনি প্রকৃত অপরাধী কিনা সে রায় আদালতই দেবেন।”

গত সোমবারের শুনানিতে প্রসিকউটর সুলতান মাহমুদ সিমন, জাহিদ ইমাম, রিজিয়া সুলতানা চমন রাষ্ট্রপক্ষে এবং অ্যাডভোকেট আব্দুস সোবহান তরফদার আসামিপক্ষের হয়ে অংশ নেন।

এম এ হান্নান ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনের এমপি। তিনিসহ এ মামলার পাঁচজন বর্তমানে আসামি কারাগারে রয়েছেন। এরা হলেন; হান্নানের ছেলে মো. রফিক সাজ্জাদ (৬২), মিজানুর রহমান মিন্টু (৬৩) ও মো. হরমুজ আলী (৭৩) ও ডা. খন্দকার গোলাম ছাব্বির আহমাদ (৬৯।

পলাতক বাকি তিনজন হলেন; মো. ফখরুজ্জামান (৬১), মো. আব্দুস সাত্তার (৬১) ও খন্দকার গোলাম রব্বানী (৬৩)। তারা সবাই ময়মনসিংহ জেলার বাসিন্দা।

তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এম এ হান্নান ১৯৭১ সালে টাঙ্গাইল থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯৫ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে ২০১৪ সালে এমপি নির্বাচিত হন তিনি।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য এম এ হান্নান। ফাইল ফটো।

হান্নানের ছেলে রফিক সাজ্জাদের বিষয়ে প্রতিবেদনে তথ্য না থাকলেও তিনিও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে জানায় তদন্ত সংস্থা। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান বেনারকে জানান, “একাত্তরে বয়স কম থাকলেও বাবার সঙ্গে নানা মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের যুক্ত ছিলেন তিনি।”

আসামি আবদুস সাত্তারও মুসলিম লীগ সমর্থক ছিলেন। এ ছাড়া বাকি আসামিরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামী ছাত্র সংঘের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে বর্তমানে তারা জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক বলে জানায় তদন্ত সংস্থা।

ময়মনসিংহের ত্রিশালের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমানের স্ত্রী রহিমা খাতুন গত বছর এ মামলাটি দায়ের করেন। সেখানকার আদালত এজাহারটি গ্রহণ করে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠায়। মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম গত ফেব্রুয়ারিতে হান্নানসহ আরো ২৫ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন।

২০১৫ সালের ২৮ জুলাই তদন্ত সংস্থা এই আট আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। পরে ট্রাইব্যুনাল আসামিদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করলে ১০ অক্টোবর ঢাকার দুটি পৃথক বাড়ি থেকে হান্নান ও তার ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপরে একে একে ডা. খন্দকার গোলাম সাব্বির, হরমুজ আলী ও মিজানুর রহমান মিন্টুকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত ১১ জুলাই তদন্ত সংস্থা ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। তাতে আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হলেও প্রসিকিউশন অভিযোগপত্রে ছয়টি অভিযোগ আনে।

এ বিষয়ে প্রসিকিউটর রিজিয়া সুলতানা চমন বেনারকে বলেন, “অভিযোগপত্রে নতুন কোনো অভিযোগ যুক্ত করা হয়নি। তদন্ত সংস্থার আনা পাঁচটি অভিযোগ ভেঙে ছয়টি করা হয়েছে।”

তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা যায়, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে; ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহে প্রখ্যাত ভাস্কর আব্দুর রশিদকে অপহরণ ও নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুম; ত্রিশালে হিন্দুপল্লী ও মুন্সিপাড়ায় অগ্নিসংযোগ, গুলি করে একজনকে হত্যা ও দুজন আহত; বৈলরের আ. রহমান মেম্বারকে আটক, অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা ও লাশ গুম; খন্দকার আব্দুল আলী রতনকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা ও লাশ গুম; মো. আবেদ হোসেন খানকে আটক, নির্যাতন ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর; কে এম খালিদ বাবুকে অপহরণ, আটক ও নির্যাতন করা। তারা এসব ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়।

এদিকে সংসদ সদস্য হান্নান আটক থাকায় দীর্ঘদিন যাবত জাতীয় সংসদে অনুপস্থিত রয়েছেন। তার সংসদ সদস্য পদ প্রসঙ্গে তুরিন আফরোজ জানান, “সংবিধান অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য ৯০ দিন সংসদে অনুপস্থিত থাকলে সদস্য পদ চলে যায়। সুতরাং তার বিষয়টি মাননীয় স্পিকার নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখবেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।