কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত তৃতীয় যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যু

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.11.18
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ফাইল ফটো
স্টার মেইল।

মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী এস এম ইউসুফ আলী (৮৬) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

এ নিয়ে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত তিনজন কারাগারে মারা গেলেন। এর আগে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ৯০ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম আমৃত্যু কারাদণ্ড নিয়ে হাসপাতালের প্রিজন সেলে মারা যান।

এ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের দায়ে ছয়জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে আরো ১১টি যুদ্ধাপরাধের মামলা।

ইউসুফের বার্ধক্যজনিত মৃত্যু

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্র জানায়, বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হলে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় ইউসুফকে কারাগার থেকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার জাহাঙ্গির কবির বেনারকে বলেন, “ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের মেডিসিন বিভাগে ইউসুফ আলীকে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছিল। সেখানেই চিকিৎসাধীন ‍অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।”

গত ১৮ জুলাই জামালপুরের যুদ্ধাপরাধী এস এম ইউসুফ আলীকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তাঁর বিরুদ্ধে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার সুবর্ণখিলা এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, লুটপাট ও মরদেহ গুমের পাঁচটি অভিযোগ ছিল। মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের মধ্যে দুটি প্রমাণিত হওয়ায় তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ে জামালপুরের আরও তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড ও দুজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

এস এম ইউসুফ আলী জামালপুরের চানপুর হরিণাকান্দা গ্রামের আব্দুল খালেক ওরফে খালেক মাস্টারের ছেলে। তিনি ১৯৭৯ সালে বন বিভাগে ফরেস্টার পদে যোগ দেন। তিনি সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জে ডেপুটি রেঞ্জার ছিলেন, পরে শরণখোলা স্টেশন কর্মকর্তা পদ থেকে অবসরে যান।

ইউসুফের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তার বড় ছেলে এস এম মোসাদ্দেক আলী মোহন বেনারকে বলেন, “শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে পুলিশ তার বাবার লাশ তাদের বুঝিয়ে দেয়। জামালপুরে নান্দিনার শ্রীপুরে তাদের বাড়িতে জানাজার নামাজ শেষে সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।”

এস এম ইউসুফ আলী। ফাইল ফটো।
এস এম ইউসুফ আলী। ফাইল ফটো।
স্টার মেইল।

ইউসুফের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত

ইউসুফের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে দুটো অভিযোগ প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত প্রথম অভিযোগ হলো; সহযোগীদের নিয়ে ১৯৭১ সালের ১০ জুলাই রাত তিনটার দিকে জামালপুরের সিঅ্যান্ডবি রোডের (পুরাতন) দয়াময়ী লেনের মল্লিক ভিলা থেকে শহীদ নুরুল আমিনকে অপহরণ করা। ওই দিন সকাল ১০টায় তাঁর মরদেহ ব্রহ্মপুত্র নদের চ্যাপতলা ঘাটে ভেসে ওঠে।

প্রমাণিত দ্বিতীয় অভিযোগ হলো; তৎকালীন জামালপুর মহকুমার ছাত্র সংঘের সভাপতি আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত বদর বাহিনীর জামালপুরের আশেক মাহমুদ ডিগ্রি কলেজকে ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহার করা। একাত্তরের ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইউসুফ ও তার সহযোগীরা অনেককে সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা করে।

ছয় যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর

২০১০ সালের ২৫ মার্চ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত ছয় বছরেরও বেশি সময়ে শীর্ষ ছয় যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করেছে আদালত। এস এম ইউসুফসহ তিন যুদ্ধাপরাধী সাজা নিয়ে হাসপাতালের প্রিজন সেলে মারা গেছে।

প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে। ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।

ওই বছরের ২১ নভেম্বর একই দিনে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

এ বছরের ১১ মে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। সর্বশেষ  গত তিন সেপ্টেম্বর মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়।

সাজাপ্রাপ্ত চারজন পলাতক

এদিকে মানবতা অপরাধে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, আশরাফুজ্জামান খান, চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও এম এ জাহিদ হোসেন খোকনের সর্বোচ্চ সাজা হলেও তারা পলাতক। বিচার প্রক্রিয়ায় অংশ না নেওয়ায় এ অপরাধীরা ধরাপড়া মাত্রই দণ্ড কার্যকরে কোনো বাধা থাকবে না।

এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি ২৫ মামলায় সাজা হয়েছে ৩১জনের। আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে সাতটি মামলা। এর আগে দুই আসামির মৃত্যু হওয়ায় তাদের মামলা তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মামলায় দুপক্ষই রিভিউ আবেদন করেছে।

ট্রাইব্যুানাল সূত্র জানায়, এখন সেখানে বিচার চলছে ১৪ জনের, আর বিচার শুরুর অপেক্ষায় আছে ১১ টি মামলা। বিচার শুরু হতে যাচ্ছে সন্দেহভাজন ৬৮ যুদ্ধাপরাধীর। আর সন্দেভাজনদের মধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে ৫৮ জনের। অন্যদিকে পলাতক যুদ্ধাপরাধী রয়েছে ৮০ জনেরও বেশি।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশ গুপ্ত সম্প্রতি বেনারকে জানান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা প্রয়োজন। এ জন্য আদালতের সংখ্যা বাড়ানো উচিত বলে মত দেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।