যুদ্ধকালে ধর্ষণকে গণহত্যার সমতুল্য বিবেচনা: যুদ্ধাপরাধী ইদ্রিস আলীর ফাঁসির রায়
2016.12.05
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তৎকালীন এক রাজাকার সদস্যকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ইদ্রিস আলী সরদার (৬৭) নামে ওই যুদ্ধাপরাধী বর্তমানে পলাতক।
তাঁকে গ্রেপ্তারের পর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাবে বলে রায়ে বলা হয়। সোমবার বিচারপতি আনোয়ারুল হক নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায় ঘোষণা করেন।
তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর এলাকায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের চারটি অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। সেসব অভিযোগ প্রমাণ হওয়া সাপেক্ষে এ রায় দিয়েছে আদালত।
এই নিয়ে এ পর্যন্ত ২৭টি মামলায় ২৮ জন যুদ্ধাপরাধীকে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
যে অপরাধে যে সাজা
ইদ্রিস আলীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন দুইশ জনকে হত্যা ও মালামাল লুট করা, অসংখ্য মানুষকে হত্যায় সহায়তা ও নারী ধর্ষণের ঘটনায় সহায়তার অপরাধে তাকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছে আদালত।
এ ছাড়া বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে চারজনকে হত্যার ঘটনায় রাজাকার ইদ্রিস আলীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং দেড় হাজারেরও বেশি হিন্দুদের ভয়ভীতি দেখিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করার অপরাধে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
এদিকে পলাতক ইদ্রিস আলীকে গ্রেপ্তার করে দ্রুত সাজা কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজির প্রতি নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। আদালতের রায়ে যুদ্ধাপরাধের এই আসামিকে আটকের প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহযোগিতাও নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
২০১০ সালের ১১ মে শরীয়তপুরের আদালতে ইদ্রিস আলী ও সোলায়মান মোল্যাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীয়তপুরের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ তালুকদার। পরে মামলাটি ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
এর প্রায় পাঁচ বছর পর তদন্ত শেষে ইদ্রিস ও সোলায়মানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। এ বছরের ২ মে তাদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় ১৩ জন সাক্ষীকে আদালতে উপস্থিত করলেও কোনো সাফাই সাক্ষীকে আনেনি আসামিপক্ষ।
তবে গত ২৫ অক্টোবর আসামি সোলায়মান মোল্যা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ায় মামলাটি থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, ঋষিকেশ সাহা ও রেজিয়া সুলতানা চমন। আর আসামিপক্ষে আইনজীবী হিসেবে গাজী এমএইচ তামিমকে নিযুক্ত করে রাষ্ট্র।
সন্তুষ্ট রাষ্ট্রপক্ষ
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বেনারকে বলেন, “আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট। আমরা কাঙ্খিত রায় পেয়েছি।”
এ রায়ে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধকালে ধর্ষণকে গণহত্যার সমতুল্য করেছেন জানিয়ে দুপুরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এটি রায়ে নতুন এক প্রাপ্তি।”
আসামিপক্ষের আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম বেনারকে বলেন, “শুরু থেকেই সরকার পক্ষের আনা সাক্ষ্যে নানা ধরনের গড়মিল ছিল। এই রায়ে আসামি ন্যায় বিচার পায়নি। রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ।”
রায়ে অস্তেুষ্ট হলেও ইদ্রিস আলী পলাতক থাকায় তিনি আপিল করবেন কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি এই আইনজীবী।
তবে অভিযুক্ত ইদ্রিস আত্মসমর্পণ করে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে খালাস পাবেন বলে আশা করেন তিনি।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, তৎকালীন জামায়াত ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সঙ্গে যুক্ত ইদ্রিস আলী যুদ্ধকালীন পাক সেনাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হন।
আর মৃত সোলায়মান মোল্যা মুসলিম লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামিয়াতুল উলামায় ই-ইসলামীতে যোগ দেওয়া সোলায়মানও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দিয়ে নারকীয় সব ঘটনায় পাক বাহিনীকে সহায়তা করেন।
এদিকে ইদ্রিস আলীর ফাঁসির আদেশ হওয়ায় আনন্দ মিছিল করেছেন শরীয়তপুরের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও সমমনা মানুষেরা।
ইদ্রিস আলীকে ‘কুখ্যাত রাজাকার উল্লেখ করে শরীয়তপুরের বাসিন্দা মাহাতাব উদ্দিন বেনারকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধকালে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ও নারীদের ধর্ষণের জন্য দায়ী রাজাকার ইদ্রিসকে ফাঁসির আদেশ দেওয়ায় আমরা অত্যন্ত খুশি। তবে এ আনন্দ পরিপূর্ণতা পাবে যখন তাকে আটকের মাধ্যমে রায়টি কার্যকর করা যাবে।”
উচ্চ আদালতেও এ রায় বহাল থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।