সব স্থাপনা থেকে মুছতে হবে স্বাধীনতা বিরোধীদের নাম
2016.12.06
যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে আইন তৈরির প্রক্রিয়া চলমান থাকার মধ্যে উচ্চ আদালত দেশের যেসব স্থাপনায় স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম রয়েছে তা মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। এই আদেশ বাস্তবায়ন করে ৬০ দিনের মধ্যে স্থানীয় সরকার সচিব ও শিক্ষাসচিবকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
একের পর এক মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টদের ফাঁসি হচ্ছে, তাঁদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আয়োজন চলছে। এরই মধ্যে স্থাপনা থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম মুছে ফেলার এই আদেশে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অনেকেই।
একটি রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।আগামী ১ মার্চ পরবর্তী আদেশের জন্য বিষয়টি আসবে।
স্বাধীনতাবিরোধীদের নামে স্থাপনা, সড়ক, অবকাঠামোর নামকরণ স্থগিত চেয়ে ২০১২ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবীর।
প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ১৪ মে রুলসহ খান এ সবুর ও শাহ আজিজুর রহমানের নাম ব্যবহার থেকে বিরত হওয়ার আদেশ দেন হাইকোর্ট।
এই নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছে না জানিয়ে গত বছরের ২৫ আগস্ট আরেকটি আবেদন করেন রিট আবেদনকারী। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট খান এ সবুর সড়কের নাম প্রত্যাহার করে আগের ‘যশোর রোড’ নামটি ব্যবহার করতে সিটি করপোরেশনের মেয়রকে নির্দেশ দেয়।
একই সঙ্গে কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শাহ আজিজুর রহমান’ মিলনায়তনের নামও প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দেয় আদালত।
গত বছরের ১ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ‘সব খানে সবুর খানের ভক্ত?’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী। শুনানি নিয়ে গত বছরের ৩ নভেম্বর হাইকোর্ট সাত দিনের মধ্যে ‘যশোর রোড’ নামটি ফিরিয়ে আনার আদেশ দেন। এ বিষয়ে গত ২৯ নভেম্বর আরেকটি আদেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু এরপর গত এক বছরেও সেই আদেশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় ২০টি স্থাপনার নামের তালিকাসহ নতুন এই সম্পূরক আবেদন নিয়ে মঙ্গলবার আদালতে হাজির হন আবেদনকারী পক্ষ।
“যারা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দণ্ড পেয়েছেন, তাদের নামে বেশ কিছু স্থাপনা রয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকার সেগুলো পরিবর্তন করেনি এবং পরিবর্তনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য এটা লজ্জাজনক ও অগ্রহণযোগ্য,” বেনারকে জানান ব্যারিস্টার এ কে রাশিদুল হক।
২০ স্বাধীনতাবিরোধীর নামে স্থাপনা
আবেদনকারী স্বাধীনতাবিরোধীদের নামে ২০টি স্থাপনার তালিকা জমা দেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক বিএনপি নেতা আব্দুল আলিমের (কারাগারে মারা যান) নামে বগুড়া জেলা পরিষদ মিলনায়তন রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের নামে হবিগঞ্জের মাধবপুরের নোয়াপাড়ায় বাসস্ট্যান্ড ও কায়সারনগর এলাকা নামকরণ হয়েছে।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার রাজাকার ও শান্তি কমিটির স্থানীয় চেয়ারম্যান এনএম ইউসুফের নামে হয়েছে ‘ইউসুফ গনি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, লংলা ইউসুফ কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একই জেলার কুলাউড়ার রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য মাহতাব উল্লাহর নামে আছে ‘মাহতাব-সায়েরা হাই স্কুল’।
সিরাজগঞ্জে ইয়াহইয়াহ স্কুল অ্যান্ড কলেজ হয়েছে একাত্তরে পাবনার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান প্রয়াত বিএনপি নেতা সাইফুদ্দীন ইয়াহইয়াহ খান মজলিসের নামে। শান্তি কমিটির নেতা আব্দুর রাজ্জাক মিয়ার নামে ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে হয়েছে ‘শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রোড’।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে রাজাকার আব্দুল আজিজের নামে ডেলকা এমসি হাই স্কুল ও বেলকা রোডে রায় জীবন ইউনিয়ন কমপ্লেক্স রয়েছে। একই জেলার ধর্মপুরে স্বাধীনতাবিরোধী আব্দুল জব্বারের নামে আছে আব্দুল জব্বার ডিগ্রি কলেজ।
হাজী তরিকুল্লাহ রোড নোয়াখালীর চৌমুহনীর রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য তরিকুল্লার নামে। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলায় রাজাকার মিয়া মনসুর আলীর নামে আছে মিয়া মনসুর আলী অ্যাকাডেমি।
এ ছাড়া কুমিল্লার দরগাবাড়ি এলাকায় শান্তি কমিটির সদস্য রেজাউর রহমানের নামে ‘রেজাউর রহমান রোড’, নাটোরে রাজাকার আব্দুস সাত্তার খানের নামে মধু মিয়া রোড, নাটোরে রাজাকার কোসের উদ্দিনের নামে কোসের উদ্দিন রোড, পুরান ঢাকায় মুজাহিদ বাহিনীর মোহাম্মদ তামিমুল এহসানের নামে রাস্তা এবং পুরান ঢাকায় মুজাহিদ বাহিনীর কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ উল্লাহ ওরফে হাফেজ্জী হুজুরের নামে রাস্তা আছে।
নরসিংদীর মনোহরদীতে সরকারি শিশু পরিবারের নামফলকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নাম আছে। ঝিনাইদহের শৈলকূপায় রাজাকার ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান শফি আহমেদের নামে পোস্ট অফিস রয়েছে।
নেত্রকোনার ফাইলাটি ইউনিয়নে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আব্দুর রহমানের নামে হাজী আব্দুর রহমান হাই স্কুল, মেহেরপুরের মুজিবনগর এলাকার রাজাকার মিয়া মনসুর আলীর নামে আনন্দবাস মিয়া মনসুর আলী অ্যাকাডেমি ও মেহেরপুর পৌর এলাকার রাজাকার ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সবদার আলীর নামে রাস্তা ও মার্কেট করা হয়েছে।
“আদালতের এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আশা করি, এভাবেই একদিন ওদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। সহায়–সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে,” বেনারকে জানান শাওন মাহমুদ, যিনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদের মেয়ে।
তিনি বলেন, “এ দেশ থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে। রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ দেখার বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।”