পশ্চিমবঙ্গে নারদ কেলেঙ্কারি মামলায় দুই মন্ত্রীসহ ৪ রাজনীতিবিদ গ্রেপ্তার

যাজ্ঞসেনী চক্রবর্তী
2021.05.17
কলকাতা
পশ্চিমবঙ্গে নারদ কেলেঙ্কারি মামলায় দুই মন্ত্রীসহ ৪ রাজনীতিবিদ গ্রেপ্তার ঘুষ নেবার অভিযোগে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করার প্রতিবাদে কলকাতায় সুরক্ষা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন দলটির সমর্থকেরা। কলকাতার নিজাম প্যালেসে সিবিআই দপ্তরের ভেতর থেকে বাইরের উত্তেজিত জনতার দিকে ঢিল ছুড়ে মারছেন সুরক্ষা বাহিনীর এক সদস্য। ১৭ মে ২০২১।
[বেনারনিউজ]

‘নারদ কেলেঙ্কারি’ নামে পরিচিত ছয় বছর আগে ঘুষ নেবার অভিযোগে সোমবার সকালে কলকাতায় গ্রেপ্তার হন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের দুই মন্ত্রীসহ চার রাজনীতিবিদ। সন্ধ্যায় তাঁরা জামিন পেলেও রাতেই উচ্চ আদালত জামিন স্থগিত করে দেয়ায় আপাতত জেলেই থাকতে হচ্ছে তাঁদের। 

সোমবার এই চার নেতাকে কলকাতায় গ্রেপ্তার করে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, কলকাতার সাবেক মেয়র ও পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, বিধায়ক মদন মিত্র এবং তৃণমূলের সাবেক শীর্ষনেতা শোভন চট্টোপাধ্যায়, যিনি দল বদলে ভারতীয় জনতা পার্টিতে (বিজেপি) যোগদান করলেও সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি ত্যাগ করেন। 

নারদ কেলেঙ্কারি প্রথম সামনে আসে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে, যখন ২০১৪ সালে গোপনে রেকর্ড করা ফুটেজে ঘুষ নিতে দেখা যায় কয়েকজনকে, যাঁদের সঙ্গে চেহারার মিল রয়েছে তৃণমূলের বেশ কিছু শীর্ষনেতা ও একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার। 

পরবর্তীতে সিবিআইর চার্জশিটে গ্রেপ্তার চার নেতাসহ আরো কয়েকজনের নাম উল্লিখিত হয়। 

এই চার নেতাকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়। দিনভর ভার্চুয়াল শুনানির পর সোমবার সন্ধ্যায় চারজনকেই জামিন দেয় বিশেষ সিবিআই আদালত। কিন্তু এর পরই নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতির এজলাসে আবেদন দাখিল করে সিবিআই। 

ভার্চুয়াল শুনানি শেষে হাইকোর্ট চার নেতার জামিন আদেশের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ জারি করে। পরবর্তী শুনানি আগামী বুধবার। ফলে অন্তত বুধবারের শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই চার নেতাকে থাকতে হবে প্রেসিডেন্সি জেলে। 

চার নেতার এই গ্রেপ্তারকে বিজেপি-শাসিত কেন্দ্র সরকারের ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ বলে আখ্যায়িত করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। 

“নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিতে পারছে না বিজেপি, তাই নানাভাবে রাজ্য সরকারকে উত্যক্ত করছে। আজকের ঘটনা তারই একটা পদ্ধতি,” বেনারকে বলেন তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ।

এই গ্রেপ্তারের বৈধতা নিয়ে “প্রশ্নের অবকাশ” রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

উত্তপ্ত কলকাতা 

সকালে কলকাতার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত জগদীশচন্দ্র বসু রোডের ওপর নিজাম প্যালেস চত্বরে সিবিআই-এর দপ্তরে ধৃতদের নিয়ে আসা হলে কার্যত রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে এলাকা। উপস্থিত সুরক্ষা বাহিনী ও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট–পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়, ব্যারিকেড ভেঙে দফায় দফায় চত্বরে ঢোকার চেষ্টা করে উত্তেজিত জনতা। 

পৌনে এগারোটা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছান তৃণমূল প্রধান ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় ছয় ঘণ্টা সিবিআই-এর দপ্তরে বসে থাকেন তিনি। 

রাজ্যে কোভিড পরিস্থিতির ক্রমাবনতি সামাল দিতে গতকাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ঘোষিত হয়েছে প্রায় পূর্ণ লকডাউন, যা চলবে ৩০ মে পর্যন্ত। লকডাউন চলাকালে সবরকম জমায়েত নিষিদ্ধ থাকলেও কলকাতাসহ রাজ্যের অন্যান্য কিছু অঞ্চলেও নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়ে পথে নামেন তৃণমূল সমর্থকেরা। 

তবে দুপুরের পর তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় টুইট করে বলেন, “বাংলার জনগণের স্বার্থে আমি সকলের কাছে লকডাউনের বিধিনিষেধ না ভাঙার আবেদন জানাচ্ছি। বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে এবং আমাদের লড়াই আইনি মতেই চলবে।” 

এদিকে লকডাউনের বিধি অমান্য করে তৃণমূল সমর্থকদের প্রতিবাদকে “আইন ভাঙা” বলে মন্তব্য করেন বিজেপির রাজ্য নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার। 

“সিবিআই তাদের তদন্তের খাতিরে গ্রেপ্তার করতেই পারে, কিন্তু তা নিয়ে জনসমাবেশ করার অর্থ আইন ভাঙা,” বেনারকে বলেন তিনি। 

আজকের সিবিআই অভিযানের অনুমতি কিছুদিন আগেই দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। কেন্দ্রের শাসকদলের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। 

বিশিষ্ট আইনজীবী ও কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ বেনারকে জানান, “রাজ্যপাল সাংবিধানিক পদে থেকে শুধু ওই চারজনের গ্রেপ্তারির অনুমতি দিয়ে অন্যায় করেছেন। নারদ মামলায় আরও যাঁরা অভিযুক্ত, তাঁরা বাদ গেলেন কেন?” 

এই বক্তব্যের ইঙ্গিত তৃণমূলের প্রাক্তন দুই নেতা মুকুল রায় এবং শুভেন্দু অধিকারীর দিকে, যাঁদের নাম নারদ কেলেঙ্কারির তদন্তে উঠে এসেছে। দুজনেই বর্তমানে বিজেপির সদস্য এবং সাম্প্রতিক নির্বাচনে নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে জয়ী ঘোষিত হন শুভেন্দু। 

এদিকে ‘ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা’র সদস্য শামিম আহমেদ বেনারকে বলেন, বিধায়কদের গ্রেপ্তারের জন্য বিধানসভার স্পিকারের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। 

তাঁর মতে সেটা না করে রাজ্যপালের অনুমতি নিয়ে ওই নেতাদের গ্রেপ্তার করার ফলে “ভারতের ফেডারেল কাঠামোর ওপর আঘাত হানা হয়েছে।” 

গত ২৭ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে ২৯২টি আসনের মধ্যে ২১৩টি জেতে তৃণমূল, ৭৭টি বিজেপি, দুটি আসনে নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়েছে ১৯ মে পর্যন্ত।  

ভারতে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী সোমবার পর্যন্ত সক্রিয় করোনা রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ ৭০ হাজার, মোট মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ৭৪ হাজার। 

পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য দপ্তর জানিয়েছে, ১৭ মে পর্যন্ত বাংলায় সক্রিয় করোনা রোগীর সংখ্যা এক লাখ ৩১ হাজার ৫৬০, মোট মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ১৩ হাজার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।