ভারতে সুপ্রিম কোর্ট বনাম বিচারপতি: নজিরবিহীন এক আইনি লড়াই

পরিতোষ পাল
2017.05.03
কলকাতা
সাংবাদিকদের মুখোমুখি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি চিন্নাস্বামী স্বামীনাথন কারনান। সাংবাদিকদের মুখোমুখি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি চিন্নাস্বামী স্বামীনাথন কারনান। ১৩ মার্চ ২০১৭।
বেনারনিউজ

কলকাতা হাইকোর্টের কর্মরত বিচারপতি চিন্নাস্বামী স্বামীনাথন কারনান এর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলাকে কেন্দ্র করে যে নজিরবিহীন আইনি লড়াই চলছে, তাতে আইনজ্ঞ ও সাবেক বিচারপতিরা উদ্বিগ্ন। একদিকে কোর্ট আদালতের এজলাস থেকে নির্দেশ দিচ্ছেন, অন্যদিকে বিচারক পাল্টা নির্দেশ দিচ্ছেন নিজ বাড়িতে আদালত বসিয়ে।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার কলকাতায় নিজ বাড়িতেই আদালত বসান বিচারপতি কারনান। তাঁর দেওয়া নির্দেশ অমান্য করে হাজিরা না দেওয়ায় নতুন করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ ডিভিশন বেঞ্চের সাত বিচারপতির বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন তিনি। কলকাতা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারকে নয়াদিল্লির পুলিশ কমিশনার বা ডিজির মাধ্যমে এই নির্দেশ কার্যকর করতে বলা হয়েছে।

এর আগে গত মার্চ মাসে সুপ্রিম কোর্ট সশরীরে হাজির করানোর জন্য বিচারপতি কারনানের বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল।

গত দুই মাসে বিচারপতি কারনান একাধিকবার বাড়িতে আদালত বসিয়ে একের পর এক সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া নির্দেশের পাল্টা নির্দেশ দিয়েছেন। এর ফলে ভারতের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে বড় সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবী ও সাবেক বিচারপতিদের একাংশ।

সাবেক কলকাতা ও সিকিম হাইকোর্টের বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত বেনারকে বলেছেন, ভারতের বিচার বিভাগে এই ধরনের ওয়ারেন্ট জারির নজির যেমন নেই, তেমনি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে পাল্টা আদালত বসিয়ে নির্দেশকারী সুপ্রিম কোর্টের বিচাপতিদের বিরুদ্ধে নির্দেশ দেওয়ার নজিরও নেই।

বিচারবিভাগে যে একটা সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা স্বীকার করে নিয়ে তিনি বিচারপতি কারনানের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

গত ১ মে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি বিচারপতি কারনানের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার নির্দেশ দেন। সাত সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চের সেই নির্দেশে কলকাতায় সরকারি হাসপাতালে বিচারপতি কারনানের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের প্রধানকে ৪ মে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সাতদিনের মধ্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট আদালতে জমা দিতেও বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য পরীক্ষায় রাজি নন জানিয়ে বিচারপতি কারনান পাল্টা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ ডিভিশন বেঞ্চের সাত বিচারপতিরই মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার নির্দেশ জারি করেছেন।

নজিরবিহীন সংকট

বিচারবিভাগে দুর্নীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে লেখা চিঠির প্রেক্ষিতে কারনানের বিরুদ্ধে গত ৮ ফেব্রুয়ারি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করে সুপ্রিম কোর্ট।

গত মাসে বিচারপতি কারনান কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন করে বিষয়টি নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট করে বলেন, “বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতেই মুখ খুলেছি। এটা জাতীয় স্তরের আলোচ্য বিষয়। এর মধ্যে অন্যায়ের কিছু নেই।”

২০ জন বিচারপতির বিরুদ্ধে বিচারপতি কারনান দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন বলে দাবি করেন। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে তিনি অভিযোগ করেন, উচ্চবর্ণের বিচারপতিরা তিনি দলিত বলেই তাঁকে সরানোর চেষ্টা করছেন।

সাবেক বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত অবশ্য বলেন, বিচারপতি কারনান বারে বারে দলিত বিদ্বেষের কথা বলে যেভাবে প্রায় সব বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নি।

আদালত অবমাননার মামলাতে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি কারনানকে দুবার আদালতে সশরীরে হাজিরা দিতে বলা সত্ত্বেও তিনি যাননি। ফলে সুপ্রিম কোর্ট গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। এর পরেও তিনি সশরীরে হাজিরা দেন নি।

স্বাধীন ভারতে এর আগে কর্মরত কোনও বিচারপতির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা পাল্টা পরোয়ানা জারি হওয়ার নজির নেই বলে জানিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী কেশব ভট্টাচার্য্য। তিনি বলেন, এর আগে বিচারপতিকে ইমপিচ করার মত ঘটনা ঘটেছে। তবে সেটা হয়েছে সংসদে।

কারনানের নির্দেশ জারি নিয়ে প্রশ্ন

বিচার বিভাগ সুত্রে বলা হয়েছে, বিচারপতি কারনান আগে মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারক ছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে কলকাতা হাইকোর্টে বদলি করা হয়। তবে আদালত অবমাননার মামলা করার পর গত ৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি কারনানকে কলকাতা হাইকোর্টের বিচার এবং প্রশাসনিক কাজ থেকে সরিয়ে দেন। বিচারপতি কারনানের জিম্মায় থাকা বিচার ও প্রশাসনিক বিষয়ের সব ফাইল কলকাতা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ারও নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।

তাই কারনানের দেওয়া একের পর এক নির্দেশের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীরা। তবে গত ১ মের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে বলেন, বিচারপতি কারনানের বিরুদ্ধে আদালত অবমামনার মামলা রুজু হওয়ার পর থেকে তিনি যে সব নির্দেশ বা রায় দিয়েছেন তা ভারতের কোনও কর্তৃপক্ষকে মানতে হবে না।

তবে কারনান দাবি করেছেন, কর্মরত বিচারপতি হিসেবে তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত বসিয়ে নির্দেশ দিতেই পারেন।

সাবেক বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত অবশ্য বেনারকে বলেন, কর্মরত বিচারপতি হওয়ায় কারনানের পদক্ষেপের মোকাবিলা করতে সুপ্রিম কোর্টকে বেগ পেতে হচ্ছে। তবে এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জুন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই বলে তিনি জানিয়েছেন। ১১ জুন ওই বিচারপতি অবসরে যাবেন।

কলকাতা হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বেনারকে বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট অকারণে এই সংকট তৈরি করেছে। বিচারপতির অভিযোগের তদন্ত না করে সুপ্রিম কোর্ট আদালত অবমাননার মামলা করে বিষয়টিকে হাস্যকর করে তুলেছে।”

“বিচারপতির মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার নির্দেশ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট নিজেদের অজান্তে বিপদ ডেকে এনেছে। এর বিপজ্জনক দিক নিয়ে আদালত একটুও ভাবল না। এর পর কেউ মামলায় হেরে গিয়ে বিচারপতির মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে,” জানান বিকাশরঞ্জন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।