মমতার আসনসহ পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় দফার নির্বাচন: উত্তেজনার মধ্যেও ভোট ৮০ শতাংশের বেশি
2021.04.01
কলকাতা
শেষ পর্যন্ত বড়ো রকমের সহিংসতা না হলেও বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা ছিল উত্তেজনার।
উত্তেজনার ভরকেন্দ্রে ছিল পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রাম, যেখানে মুখোমুখি হয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও শাসকদল তৃণমূলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সদ্য তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া শীর্ষ নেতা শুভেন্দু অধিকারী।
পূর্ব মেদিনীপুর ছাড়াও বৃহস্পতিবার ভোট হয় দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বাঁকুড়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়, যদিও সকলের নজর ছিল নন্দীগ্রামের দিকেই।
এবারের নির্বাচনে বাঁচা–মরার লড়াইয়ে তৃণমূল এবং বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করতে মরিয়া বিজেপি–এমন মন্তব্য আগেই করেছেন একাধিক বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মতে, এর প্রধান কারণ মমতার বিজেপি-বিরোধী শক্ত অবস্থান।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নন্দীগ্রামে চড়তে থাকে উত্তেজনা। বিশেষ করে বয়ালের একটি বুথে সকাল থেকেই বারবার অভিযোগ ওঠে যে, গ্রামবাসী ভোট দিতে পারছে না, তাঁদের বুথে ঢুকতে দিচ্ছে না কিছু ‘বহিরাগত’, সঙ্গে জমা পড়ছে জাল ভোট।
দুপুরের কিছু পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছান মমতা। অপরিসর পথ পেরিয়ে তাঁর কনভয় বুথ পর্যন্ত যেতে পারেনি, ফলে গাড়ি থামিয়ে হুইলচেয়ারে বসেই বাকি পথ পার করেন তিনি।
গত ১০ মার্চ নন্দীগ্রামে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে গাড়ির দরজার আঘাতে পায়ে ফ্র্যাকচার হয় তাঁর। ঘটনার পর তৃণমূল অভিযোগ করে, বিরোধী দলের ‘ষড়যন্ত্রের’ ফলেই আহত হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী, যদিও তার কোনো প্রমাণ মেলেনি।
তার পর থেকে চিকিৎসকদের পরামর্শ অমান্য করে পায়ে প্লাস্টার থাকা সত্ত্বেও হুইলচেয়ারে বসেই নির্বাচনী প্রচারে নেমেছেন মমতা।
বুথের বাইরে নেত্রীকে দেখতে পেয়ে ভোট দিতে না পারার অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় তৃণমূল কর্মী এবং গ্রামবাসীরা।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন মমতা।
“সকাল থেকে স্থানীয়দের ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। আমি সকাল থেকে প্রচার করছি… আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি, দয়া করে একটু দেখুন,” বলতে শোনা যায় তাঁকে।
তবে বিজেপি কর্মীরা উপস্থিত বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, গ্রামে বহিরাগত কেউ নেই।
এরপর বুথে উপস্থিত সংবাদমাধ্যমে মমতা দাবি করেন, নন্দীগ্রামে ভারতের গৃহমন্ত্রী অমিত শাহের নির্দেশে বিজেপিকে ‘সাহায্য’ করেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী।
তবে মমতা এ কথাও বলেন যে, নন্দীগ্রামে তাঁর বিজয় নিশ্চিত। এই কেন্দ্রেই প্রায় দেড় দশক আগে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের প্রস্তাবিত ‘কেমিক্যাল হাব’ গড়ে তোলার বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনে সামিল হয় তৃণমূল।
সরকারি হিসেবে তখন পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘাতে মৃত্যু হয়েছিল ১৪ জন আন্দোলনকারীর। অবশেষে ২০০৭ সালের মে মাসে বাতিল হয়ে যায় সরকারের প্রস্তাব।
অন্যদিকে নন্দীগ্রামের বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ নেই তাঁর। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, “কোনো অভিযোগ নেই। দু–একটি জায়গায় যে গোলমাল হচ্ছে সে খবর আমি আগেই পেয়ে যাচ্ছি।”
বিজেপির তরফে অবশ্য অভিযোগ, বৃহস্পতিবার নন্দীগ্রামের সাতেঙ্গাবাড়ি এলাকায় শুভেন্দুর গাড়ি লক্ষ্য করে ইট ছোড়া হয়। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
এদিকে সকালে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর থেকেই পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষিপ্ত রাজনৈতিক সংঘর্ষের খবর আসতে শুরু করে।
বৃহস্পতিবার সকালে কেশপুরেই হামলা হয় বিজেপি প্রার্থী প্রীতীশরঞ্জন কুঁয়ার এবং তাঁর নির্বাচনী এজেন্ট তন্ময় ঘোষের উপর। তাঁদের গাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি হামলা করা হয় কিছু সংবাদমাধ্যমের ওপরও। শান্তিভঙ্গের অভিযোগে ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার দীনেশ কুমার।
রাজনীতি বিশেষজ্ঞ শুভময় মিত্রের মতে, “যতটা হিংসার আশঙ্কা করা হয়েছিল, তার প্রায় কিছুই হয়নি।”
তিনি বলেন, “সকাল থেকে আমরা টিভিতে দেখলাম, বিভিন্ন বুথে ঘুরছেন শুভেন্দু। দুপুরের পর বেরোলেন মমতা। এই দুইয়ের তালমিল যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং। একসঙ্গে কোথাও দেখা যায়নি তাঁদের। আমার মতে, বাম-কংগ্রেস জোটকে আটকানোর লক্ষ্যে লড়ছে দুই দলই।”
বৃহস্পতিবার নন্দীগ্রামসহ মোট ৩০টি কেন্দ্রে ভোটদান হয় পূর্ব মেদিনীপুরে। বিক্ষিপ্ত হিংসার ঘটনায় দৃশ্যত কোনো প্রভাব পড়েনি ভোটদানে। ভারতের নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত দুই মেদিনীপুরে ভোট পড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের নির্বাচনে সারা পশ্চিমবঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় ভোটদানের হার ছিল ৭৯ শতাংশের বেশি। সেবার ২১১টি আসনে জিতে রাজ্য সরকার গঠন করে তৃণমূল। কংগ্রেস পায় ৪৪টি আসন, সিপিএম ২৬টি এবং তিনটি আসনে জিতে যৌথভাবে চতুর্থ স্থান দখল করে বিজেপি।