শেষ হবার পথে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন, মহামারির কারণে কমেছে ভোটার উপস্থিতি
2021.04.27
কলকাতা
পশ্চিমবঙ্গে করোনাভাইরাসে লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত, এগারো হাজারের বেশি মৃত্যু—এমনই এক দুর্বিসহ পরিবেশে প্রায় মাসজুড়ে চলমান বিধানসভা নির্বাচন শেষ হচ্ছে ২৯ এপ্রিল।
বিজেপি শিবির ছাড়া প্রায় সব দলের আপত্তির মুখে আট দফায় অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের ফল ঘোষিত হবে ২ মে।
তবে বাড়তে থাকা করোনার সংক্রমণের কারণে আট দফা নির্বাচনের শেষভাগে এসে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির সংখ্যা বেশ কমেছে।
“আমি ভোট দিতে যাইনি। এই আবহে ভোট করার বিরুদ্ধে এটা আমার প্রতিবাদ, রাজ্য এবং কেন্দ্র—দুই সরকারের বিরুদ্ধেই,” বেনারকে বলেন একটি করপোরেট সংস্থার কর্মকর্তা করোনা-ফেরত শুভদীপ বসু (৪৭)।
“বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-পরিজনের জন্য মরিয়া হয়ে বেড, ওষুধ, অক্সিজেনের জন্য ছোটাছুটি করছি আমরা। এই অবস্থায় রাজনীতির দিকে মন যাবে কীভাবে? তা ছাড়া, ভোট দেওয়ার ভিড়ে আরও একবার করোনা আক্রান্ত হতে চাইনি আমি,” বলেন শুভদীপ।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গসহ আরও চার রাজ্যে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন সম্পর্কে সোমবার মাদ্রাজ হাইকোর্ট মন্তব্য করে যে, দেশে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য সরাসরি দায়ী ভারতের নির্বাচন কমিশন।
কমিশন আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ‘খুনের অভিযোগ দায়ের হওয়া উচিত’—এমন মন্তব্য করে উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি রামমূর্তির একটি বেঞ্চ।
মাদ্রাজ হাইকোর্টের এই মন্তব্য সমর্থন করে সোমবার ফেসবুক লাইভে সম্প্রচারিত এক ভার্চুয়াল নির্বাচনী প্রচারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বিজেপির ‘তোতাপাখি’ হয়ে উঠেছে নির্বাচন কমিশন।
একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই ২৭ মার্চ থেকে শুরু করে আট দফায় নির্বাচন হয়েছে, যদিও ভোট প্রচারের শেষ পর্বে করোনা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে নির্বাচন কমিশন ৫০০ জনের বেশি জনসমাবেশ করা যাবে না বলে এক আদেশ জারি করেছে গত ২২ এপ্রিল। যদিও তা কার্যকর করতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেনি কমিশন।
এছাড়া মঙ্গলবার জারি করা অন্য একটি বিজ্ঞপ্তিতে কমিশন জানিয়েছে, ২ মে ফলাফল ঘোষণার পর কোনোরকম বিজয় মিছিল বা সমাবেশ করা যাবে না। ফলাফলের সার্টিফিকেট নিতে যাওয়ার সময় বিজয়ী প্রার্থী বা তাঁর প্রতিনিধির সঙ্গে দু’জনের বেশি যেতে পারবেন না, এমনটাও আদেশ দিয়েছে কমিশন।
এর আগে শেষ কয়েক দফার নির্বাচন একসঙ্গে করার বিষয়ে বিজেপি-বিরোধী দলগুলোর প্রস্তাব কমিশন খারিজ করে দেয়।
জিততে মরিয়া বিজেপি
পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসকে হারিয়ে জিততে মরিয়া বিজেপি, এমনটা বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা।
“নির্বাচন যখন শুরু হয়, তখন হয়তো রাজ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের তকমা পেলেই খুশি থাকত বিজেপি। কিন্তু এই এক মাসে পরিস্থিতিতে বিস্তর ফারাক ঘটেছে,” বেনারের কাছে মন্তব্য করেন রাজনীতি বিশেষজ্ঞ শুভময় মিত্র।
তিনি বলেন, “করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্র সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বিজেপি তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে ক্রমশ ক্ষোভ বাড়ছে। এখন পশ্চিমবঙ্গে জেতা বিজেপির পক্ষে আরও দশগুণ জরুরি হয়ে উঠেছে, নাহলে জাতীয় স্তরে লড়াইটা বেশ কঠিন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।”
তবে কলকাতার ‘ডক্টরস ফর পেশেন্টস’ সংস্থার কর্ণধার ডাক্তার শারদ্বত মুখোপাধ্যায়ের মতে, আট দফার নির্বাচনের ফলে হয়তো লাভবানই হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। কারণ একদিনে ভোট হলে বিপুল সংখ্যক মানুষের জমায়েত আটকানো যেত না।
“বাংলার করোনা পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটজনক,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই সময় সরকারের উচিত ছিল কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া, কিন্তু রাজ্য সরকার বর্তমানে অচল, প্রশাসন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত।”
পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য দপ্তরের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ২৭ এপ্রিল রাজ্যে নতুন করে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১৬ হাজার ৪০৩ জন। এখন পর্যন্ত মোট সক্রিয় কেসের সংখ্যা ১ লাখ ৬১৫, মৃত্যু হয়েছে ১১ হাজার ৮২ জনের।
তবে এই তথ্যের বিরোধিতা করে টুইট করেছেন কলকাতার প্রখ্যাত চিকিৎসক কুণাল সরকার। তাঁর দাবি, সক্রিয় কেসের আসল সংখ্যা সরকারি সংখ্যার অন্তত পাঁচগুণ। তাঁর মতে, কোভিড আক্রান্তদের জন্য আরও অনেক বেশি হাসপাতালের বেড বরাদ্দ করা প্রয়োজন।
“মানুষ যেখানে হন্যে হয়ে বেড খুঁজছেন, সেখানে ৬০ শতাংশ বেড হাতে রেখে দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না,” লিখেছেন তিনি।
এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত ডাঃ মুখোপাধ্যায় বলেন, “মমতা ব্যানার্জি নির্বাচন কমিশনকে যতই দোষ দেন, কোভিড সংকট সেইসব রাজ্যেও দেখা দিয়েছে যেখানে নির্বাচন হচ্ছে না। ওঁর মনে রাখা উচিত ছিল, যতদিন ওঁর সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, ততদিন উনি মুখ্যমন্ত্রী।”
রাজ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এলাকাগুলোর তালিকার শীর্ষে কলকাতা, যেখানে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সক্রিয় কেসের সংখ্যা প্রায় ২৪ হাজার। এই আবহে দক্ষিণ কলকাতায় গতকালের ভোটপর্বে ভোটদান করেননি অনেকেই।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যে গতকাল সপ্তম দফার নির্বাচনে ভোট পড়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ, যদিও দক্ষিণ কলকাতা বিধানসভার ক্ষেত্রে ভোটের হার ছিল মাত্র ৫৩ শতাংশ।
রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ত্রিমুখী নির্বাচনে জেতার লড়াই হবে বিজেপি, তৃণমূল এবং বাম-কংগ্রেস জোটের মধ্যে। বিধানসভার ২৯৪টি আসনের মধ্যে ন্যূনতম সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য পেতে হবে ১৪৮ টি আসন।
“বিজেপি বা তৃণমূল যেই জিতুক, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই জিতবে,” মন্তব্য করে শুভদীপ বসু বলেন, “বিজেপি কিন্তু ১২০টি আসন পেলেও এদিক ওদিক থেকে আরও কিছু আসন যোগাড় করে নিয়ে সরকার গঠনের দাবি তুলতে পারে।”
নির্বাচনের প্রতিটি দফায় বিক্ষিপ্ত হিংসার খবর থাকলেও সবচেয়ে গুরুতর ঘটনাটি ঘটে ১০ এপ্রিল, সেদিন চতুর্থ দফার ভোট চলাকালে কেন্দ্রীয় সুরক্ষা বাহিনীর গুলিতে কুচবিহার জেলার শীতলকুচি কেন্দ্রে নিহত হন চার জন।
জেলার পুলিশ সুপার দেবাশিস ধর ওই ঘটনার পর এক ভিডিও বার্তায় জানান, উত্তেজিত জনতার মুখোমুখি হয়ে আত্মরক্ষার স্বার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হন সুরক্ষা কর্মীরা।
একই দিনে শীতলকুচির আরেকটি নির্বাচনী বুথে তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষে গুলি চালানোর ঘটনায় নিহত হন ১৮ বছরের এক যুবক, যদিও এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত দুষ্কৃতকারীদের শনাক্ত বা গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে নতুন করে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সোয়া তিন লাখ। এখন পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এক কোটি ৭৬ লাখের বেশি, এই রোগে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন প্রায় দুই লাখ মানুষ।