পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে চতুর্মুখী লড়াইয়ে অচলাবস্থা

পরিতোষ পাল
2018.05.04
কলকাতা
কলকাতা হাইকোর্টের বাইরে সাংবাদিকদের সাথে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে করা নিজের মামলা নিয়ে কথা বলছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরি কলকাতা হাইকোর্টের বাইরে সাংবাদিকদের সাথে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে করা নিজের মামলা নিয়ে কথা বলছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী। ৪ মে ২০১৮।
বেনারনিউজ

পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে চতুর্মুখী লড়াইয়ে কার্যত অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন আইনি বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।

সরকার বনাম নির্বাচন কমিশনের তীব্র মতপার্থক্যের পাশাপাশি কমিশনের সঙ্গে আদালত ও বিরোধীদের আইনি লড়াই নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্থবির করে রেখেছে বলে মনে করেন ভোটারারও।

শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টে একাধিক বেঞ্চে নির্বাচন সংক্রান্ত মামলার শুনানী হয়। একটি ডিভিশন বেঞ্চের মামলায় বিচারপতি কমিশনের কাজের তীব্র সমালোচনা করেন।

মামলাকারী ঋজু ঘোষাল বেনারকে বলেন, “আদালত তার পর্যবেক্ষণে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন।”

বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দারের ডিভিশন বেঞ্চ শুক্রবার তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেন, “আদালত নির্বাচন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু তাই বলে নির্বাচন কমিশন যা খুশি তাই করতে পারে না।”

তবে প্রধান বিচারপতি জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চে নির্বাচনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত মামলায় প্রধান বিচারপতি জানান, পঞ্চায়েত সংক্রান্ত আরও অনেক মামলা চলছে সিঙ্গল বেঞ্চে। সেই মামলাগুলোর রায় এখনও বেরোয়নি। এই অবস্থায় তাঁর রায় দেওয়াটা ঠিক নয়। তিনি মামলার পরবর্তী শুনানীর দিন ধার্য্য করেন আগামী মঙ্গলবার।

বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক মহলের মতে, সেদিনই সম্ভবত স্পষ্ট হবে নির্বাচন ফের পিছিয়ে যাবে নাকি নির্ধারিত দিনে হবে।

ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায় বেনারকে বলেন, “আগামী মঙ্গলবার প্রধান বিচাপতির ডিভিশন বেঞ্চের রায় থেকে জানা যাবে নির্বাচন কবে হবে এবং কত দফায় হবে।”

গত ২১ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন একদিনে ১৪ মে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণ করলেও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সুব্রত তালুকদারের ডিভিশন বেঞ্চ গত মঙ্গলবার সেটিকে শুধুই “প্রস্তাবিত তারিখ” বলে তাঁর পর্যবেক্ষণে মন্তব্য করেন।

গত ৩১ মার্চ রাজ্য নির্বাচন কমিশন প্রথম তিন দফায় ১, ৩ ও ৫ মে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু মনোনয়ন পর্বে প্রবল অশান্তি ও সন্ত্রাসের আবহের অভিযোগে বিভিন্ন বিরোধী দল আদালতে যায়। আদালত এক পর্যায়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া বন্ধ রাখে। এবং মনোনয়নের দিন একদিন বাড়ানোর নির্দেশ দেয়।

তবে নিরাপত্তার বিষয়টি সুনিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেবার জন্য আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন একতরফাভাবে রাজ্য সরকারের সুপারিশে তিন দফার নির্বাচন এক দফায় ১৪ মে নির্ধারণ করার বিজ্ঞপ্তি জারি করে।

আদালতে আধ ডজনের বেশি মামলা

পঞ্চায়েত নির্বাচনের শুরু থেকেই সন্ত্রাসের আবহ তৈরি হওয়ার অভিযোগে বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল আদালতের কাছে নানা অভিযোগে মামলা করে। আদালত সূত্রের খবর, এখন পর্যন্ত আধ ডজনের বেশি মামলা হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে।

এর মধ্যে কোনোটি নিরাপত্তা সংক্রান্ত, কোনোটি বিজ্ঞপ্তি খারিজ, কোনোটি সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়া তিন দফা থেকে এক দফায় নির্বাচন ঘোষণা, কোনোটি ‘ই-মনোনয়ন’ গ্রাহ্য করার দাবি সংক্রান্ত মামলা। এগুলি দায়ের করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি, আইনজীবী ও রাজনৈতিক দল।

ভারতের লোকসভার সাবেক স্পীকার ও প্রবীণ আইনজীবী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় হতাশা প্রকাশ করে গণমাধ্যমকে বলেন, “আমি আমার দীর্ঘ জীবনে একটি নির্বাচন নিয়ে এত মামলার কোনো নজির দেখিনি।”

তিনি মনে করেন, “নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক সংস্থা। তাই কমিশনের নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত।”

তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, পঞ্চায়েত নির্বাচন করার প্রশ্নে বিরোধীরা ষড়যন্ত্র করছে।

নিরাপত্তার প্রশ্ন অমীমাংসিত

“নিরাপত্তার প্রশ্নটি এখনও পর্যন্ত অমীমাংসিতই রয়ে গিয়েছে”, বলেন বিরোধী দল পার্টি অব ডেমোক্রাটিক সোস্যালিজম(পিডিএস) নেতা সমীর পুততুন্ড। তিনি বেনারকে বলেন, “নির্বাচন কমিশন যেভাবে নিরাপত্তার সুস্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি না করেই এক দফায় নির্বাচন ঘোষণা করেছে সেটা সকলকে বিস্মিত করেছে।”

নির্বাচন পর্ব থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত রাজ্যে নির্বাচনী সন্ত্রাস অব্যাহত রয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশিত হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিরোধী প্রার্থীদের উপর আক্রমণের পাশাপাশি চলছে শাসক দলের বিক্ষুব্ধ প্রার্থীদের নানাভাবে চাপ সৃষ্টির ঘটনা। মৃত্যুর ঘটনাও থেমে নেই।

রাজ্য সরকার নির্বাচন কমিশনের কাছে পুলিশি ব্যবস্থা নিয়ে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট নয় কমিশন। নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকারের দেওয়া তথ্যে অনেক অসম্পূর্ণতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশনের এক আধিকারিক।

নির্বাচনের কাজের সঙ্গে যুক্ত এক আধিকারিক বলেন, বুথের চরিত্র (অতি স্পর্শকাতর, স্পর্শ কাতর) নির্ধারণের কাজটিও এখন পর্যন্ত কমিশন করে উঠতে পারেনি।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে খবর, পর্যবেক্ষক ও ভোটকর্মীদের নিরাপত্তা, ব্যালট বাক্স, ভোটের উপকরণের সুরক্ষা, হঠাৎ কোথাও আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হলে তা সামলানো-সহ একাধিক কাজে অতিরিক্ত যে বাহিনী প্রয়োজন হবে সে সম্পর্কে কমিশনের কাছে নিশ্চিত কোনও তথ্য জানায়নি রাজ্য সরকার।

পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভোটার শিক্ষক কালীপদ কর্মকার বেনারকে বলেন, “নির্বাচন কমিশনের কাজই হচ্ছে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য আস্থার পরিবেশ তৈরি করা। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সে ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত ব্যর্থই হয়েছে। তাই ভোটের দিন পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা নিয়েই ভোটাররা শঙ্কিত।”

বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ৩৪ শতাংশ

নির্বাচন নিয়ে আইনি জটিলতা কাটার আগেই ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে ২০০৭৬ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন বলে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে।

কমিশনের এক আধিকারিক বলেন, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পরে গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪৮,৬৫০ আসনের মধ্যে ১৬,৮১৪, পঞ্চায়েত সমিতির ৯,২১৭ আসনের মধ্যে ৩,০৫৯ এবং জেলা পরিষদের ৮২৫টি আসনের মধ্যে ২০৩টিতে জয় পেয়েছেন প্রার্থীরা।

দু একটি ক্ষেত্র ছাড়া এই সব আসনে শাসক দলের প্রার্থীরাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “৩৪.২০ শতাংশ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের ইতিহাসে একটি রেকর্ড। ইতিপূর্বে ২০০৩ সালে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ আসেন প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।”

তিনি বলেন, “মনোনয়ন পর্বে শাসক দলের লাগামছাড়া সন্ত্রাস দেখেই বোঝা গিয়েছিল যে, বেশি সংখ্যক আসনে জয় নির্বাচনের আগেই হাসিল করা ছিল তাদের লক্ষ্য। ৫০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রার কাছে শাসক দল পৌঁছাতে না পারলেও ৩৪.২০ শতাংশে তারা সহজেই জয় ছিনিয়ে এনেছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।