পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী আসনের ফল ঘোষণা

পরিতোষ পাল
2018.08.24
কলকাতা
180824_WB_story_620.jpg সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর নদীয়া জেলার মওপাড়া পঞ্চায়েতের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীদের নিয়ে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের বিজয়োল্লাস। ২৪ আগস্ট ২০১৮।
বেনারনিউজ

পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের নির্বাচন শেষ হওয়ার তিন মাস পরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী আসনের ফল ঘোষণার নির্দেশ দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।

শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র, বিচারপতি এ এম খান উইলকর ও বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ ভারতীয় জনতা পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্কসবাদী দলের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী আসনে নতুন করে নির্বাচনের দাবি খারিজ করে এই নির্দেশ দেন।

বিচারপতিরা অবশ্য তাঁদের পর্যবেক্ষণে বলেন, বিপুলসংখ্যক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় মারাত্মক বিষয়। তবে এ নিয়ে কোনো অভিযোগ জানাতে হলে ফল প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে তা নির্বাচনী পিটিশনের মাধ্যমে নির্বাচন ট্রাইব্যুনালে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গত ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীদের ফল প্রকাশ করে বিজ্ঞপ্তি জারি না করার নির্দেশ দেয়। ই-মনোনয়নের বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশকে এদিন সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ খারিজ করে দেয়।

কলকাতা হাইকোর্টের এই নির্দেশের বিরুদ্ধেই রাজ্য নির্বাচন কমিশন সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল। সেখানেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের বিষয়টি তুলে ধরে নির্বাচনে ব্যাপক হিংসা ও বাধাদানের অভিযোগ জানায় বিরোধী দলগুলি।

গত ১৪ মে আদালতের নির্দেশে রাজ্যের তিন স্তরের পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ৩৪ দশমিক ২ শতাংশ আসনে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীদের ফল ঘোষণা করায় পঞ্চায়েতের তিন স্তরে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বোর্ড গঠন নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল তার সমাধান হলো।

রাজ্যের তরফে সুপ্রিম কোর্টে জানানো হয়েছিল, গত শনিবারই ৩ হাজারের বেশি গ্রাম পঞ্চায়েতের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ফলে সাংবিধানিক সংকট ছাড়াও উন্নয়নের ২২ হাজার কোটি টাকা ফেরত চলে যাচ্ছে।

শাসক দলের পক্ষ থেকে এই রায়কে ঐতিহাসিক আখ্যা দেওয়া হযেছে। অন্যদিকে বিরোধীরা এই রায়ে হতাশই হয়েছে। তবে তারা পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে।

বিরোধীদের অভিযোগ

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে বিরোধীরা মনোনয়ন পর্ব থেকে অভিযোগ করে, শাসক দল সন্ত্রাস করে ও হুমকি দিয়ে বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে বাধা দেয়। এ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা হয়।

কমিশন সূত্রে বলা হয়, ৩৩৫৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪৮ হাজার ৬৫০টি আসনের মধ্যে ১৬ হাজার ৮৬০টি আসনে, ৩৪১টি পঞ্চায়েত সমিতির ৯ হাজার ২১৭টি আসনের মধ্যে ৩ হাজার ৯৬টি আসনে এবং ২০টি জেলা পরিষদের ৮২৫টি আসনের মধ্যে ২০৩টি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি।

সুপ্রিম কোর্টের এ দিনের রায়কে ঐতিহাসিক বলে অভিহিত করে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বেনারকে বলেন, “আদালত বিরোধীদের কোনো অভিযোগকেই মান্যতা দেয়নি। এই রায়ে ন্যায়ের জয় হয়েছে।”

তিনি বলেন, “এবার আমরা পঞ্চায়েত বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া পুরোপুরি শুরু করে দেবো। এই রায়ের ফলে রাজ্যে পঞ্চায়েত স্তরে উন্নয়ন নিশ্চিতভাবে গতি পাবে।”

ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গ কমিটির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে হতাশ হয়েছেন। তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম আদালত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী আসনগুলিতে নতুন করে নির্বাচনের নির্দেশ দেবেন। কিন্তু তা হয়নি। অথচ বিচারপতিরা শুনানির সময় এত আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন।”

তিনি আরও বলেন, “আদালতের নির্দেশে নতুন করে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। আমরা তাই সব আসনেই মামলা করব।”

কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্কসবাদী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেব বেনারকে বলেন, “শুনানির সময় বিচারপতিরা যে সব মন্তব্য করেছিলেন, এদিনের রায়ে তা প্রতিফলিত হয়নি।”

“যাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের বিষয়টি নিয়ে আইনজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে। আইনের পথ খোলাই রয়েছে”, বলেন তিনি।

-মনোনয়নে মান্যতা নয়

ধারাবাহিক সন্ত্রাস ও বাধাদানের পরিপ্রেক্ষিতে ই-মনোনয়নের দাবিকে কলকাতা হাইকোর্ট আংশিকভাবে মান্যতা দিলেও সুপ্রিম কোর্ট তা খারিজ করে দেয়।

কলকাতা হাইকোর্ট গত এপ্রিল মাসে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৯ জনের হোয়াটস অ্যাপে পাঠানো মনোনয়নপত্র গ্রহণ করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেয়।

সেই মতো নির্বাচন কমিশন সেগুলোকে বৈধ মনোনয়নপত্র বলে গ্রহণও করে বলে জানান নির্বাচন কমিশনের সচিব নীলাঞ্জন শান্ডিল্য।

তবে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টে শুনানির সময় বলেন, রাজ্যে পঞ্চায়েত আইনে ই-মনোনয়নের কোনো সংস্থানই নেই।

তবে আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য আদালতে দাবি করেন, ইনফরমেশন টেকনোলজি আইনে ই-মনোনয়নকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট এদিন কলকাতা হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশকে খারিজ করে বলেছে, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মনোনয়ন দাখিলকে মান্যতা দিয়ে হাইকোর্ট ভুল করেছে। দ্য রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপলস অ্যাক্টের কোনো ধারায় এই ধরনের ব্যবস্থার কোনো উল্লেখ বা অনুমোদন নেই।

আইনগত লড়াই চলবে

“সুপ্রিম কোর্টের রায়ে শাসক দলের উল্লসিত হওয়ার কারণ থাকলেও বিরোধীদের আইনগত লড়াইয়ের সুযোগ এখনো যায়নি। তবে বিরোধীদের বর্তমান যে সাংগঠনিক ক্ষমতা তাতে তারা কতটা এগোতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে,” বেনারকে বলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ।

তিনি বলেন, “আপাতত পঞ্চায়েতের কাজ শুরু হওয়ার পথ সুগম হলো ঠিকই কিন্তু নতুন আইনগত লড়াইয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক তিক্ততা আগামী দিনে আরও বাড়বেই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।