স্বাধীন ভারতে কলকাতার প্রথম মুসলিম মেয়র ফিরহাদ হাকিম

পরিতোষ পাল
2018.12.03
কলকাতা
181203_WB_Mayor_1000.jpg কলকাতা পুরসভার মেয়রের চেয়ারে উপবিষ্ট নতুন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। পাশে দাঁড়িয়ে ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ। সঙ্গে আরও রয়েছেন মেয়রের পরিবারের সদস্যরা। ৩ ডিসেম্বর ২০১৮।
[বেনারনিউজ]

পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার নতুন মেয়র হিসেবে সোমবার শপথ নিয়েছেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত ফিরহাদ হাকিমকে বিকেলে শপথ বাক্য পাঠ করান কলকাতা পুরসভার চেয়ারপার্সন মালা রায়। এরপর নবনিযুক্ত মেয়র ফিরহাদ হাকিম ডেপুটি মেয়র হিসেবে অতীন ঘোষ ও অন্যান্যদের মেয়র পারিষদ হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করান।

স্বাধীন ভারতে ফিরহাদ হাকিমই হলেন কলকাতা পুরসভার প্রথম মুসলিম মেয়র। বাঙালির ঐতিহ্য মেনে এদিন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে শপথ নেন ফিরহাদ হাকিম।

শপথ গ্রহণের পর নবনিযুক্ত মেয়র সাংবাদিকদের বলেন, “কলকাতা পুরসভার মেয়র পদের গরিমাই আলাদা। সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, বিধান চন্দ্র রায়ের মতো মানুষ এই মেয়রের চেয়ারে বসেছেন। তাই এই চেয়ারের মর্যাদাই আলাদা।”

তিনি আরও বলেন, “কলকাতাবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করাই এখন আমার দায়িত্ব। নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করব।”

ফিরহাদ আরও বলেন, “আমার পরিচয় কর্মের মধ্যে, ধর্মের মধ্যে নয়৷”

আগামী লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে ফিরহাদকে মেয়র করার পেছনে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক কৌশলই দেখছেন বিশ্লেষকরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “ফিরহাদ হাকিমকে সংখ্যালঘু মুখ হিসেবেই তুলে ধরা হলো। তৃণমূল কংগ্রেস চাইছে তাদের মুসলিম ভোটকে ধরে রাখতে। সে ব্যাপারেই পরিস্কার বার্তা দেওয়া হলো।”

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “কলকাতার জনবিন্যাসের ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে কলকাতায় প্রায় ৪০ শতাংশ মুসলিম ভোটার রয়েছে।”

পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সভাপতি মহম্মদ কামরুজ্জামানও মনে করেন, “এটা একটি রাজনৈতিক কৌশল মাত্র।”

তিনি বেনারকে বলেন, “কলকাতার মেয়র পদে একজন মুসলিমকে বসিয়ে মুসলিমদের ক্ষোভকে প্রশমিত করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এতে মুসলিম সমাজ সামগ্রিভাবে মোটেই খুশি নয়।”

কলকাতা পুরসভার বর্তমান মেয়াদকাল ২০২০ পর্যন্ত।

এদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও এদিন কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে ফিরহাদ হাকিম নির্বাচিত হননি। মেয়র পদে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সামিল হয়েছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) তিনবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর মীনা দেবী পুরোহিত।

তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী ফিরহাদ হাকিম ১২১টি (অসুস্থতার জন্য একজন অনুপস্থিত ছিলেন) ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। বিজেপি প্রার্থী পান ৫টি ভোট।

গত কয়েক দশকে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি নির্বাচিত কাউন্সিলর না হওয়া সত্ত্বেও মেয়র নির্বাচিত হলেন।

বর্তমান পুরসভার ১৪৩টি আসনের মধ্যে ১২২টি আসন তৃণমূল কংগ্রেসের, ১৪টি বামফ্রন্টের, ৫টি বিজেপির এবং ২টি আসন কংগ্রেসের দখলে রয়েছে।

কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট এদিন কাউন্সিল অধিবেশনে শুরুতে প্রবেশ করলেও পরে তারা নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ওয়াকআউট করেন।

বিরোধী দলনেত্রী রত্না রায় মজুমদার বলেন, “পুর আইনকে অমান্য করে হওয়া মেয়র নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে আমরা বিক্ষোভ দেখিয়েছি।”

গত ২০ নভেম্বর কলকাতার মেয়র পদ থেকে ইস্তফা দেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপড়েনের ফলে কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ছেন, এই অভিযোগে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে পদত্যাগ করতে বলেন।

এরপরেই দলীয় কাউন্সিলরদের বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা পুরসভার পরবর্তী মেয়র হিসেবে ফিরহাদের নাম ঘোষণা করেন।

পুর আইন সংশোধন

নিয়ম অনুযায়ী কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলররা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। পরে কাউন্সিলারদের ভোটে নির্বাচিত হন মেয়র। আগে শুধু নির্বাচিত কাউন্সিলররাই মেয়র পদের জন্য প্রার্থী হতে পারতেন। সম্প্রতি পুরসভা আইন সংশোধন করায় নির্বাচিত কাউনসিলর নন, এমন ব্যক্তিও মেয়র পদে প্রার্থী হতে পারবেন।

নির্বাচিত কাউন্সিলর না হওয়ায় ফিরহাদ হাকিমকে মেয়র করার পথ পরিস্কার করতে তড়িঘড়ি কলকাতা পুর আইন (১৯৮০) সংশোধন করা হয়।

গত ২২ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাশ হওয়া নতুন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, কাউন্সিলর নন এমন ব্যক্তিও মেয়র হতে পারবেন। তবে তাঁকে ছয় মাসের মধ্যে কাউন্সিলর হিসেবে নির্বচিত হয়ে আসতে হবে।

এই পুর আইন সংশোধন অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দেন বিরোধীরা।

কলকাতা পুরসভার ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির কাউন্সিলর বিলকিস বেগম কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন।

বিলকিস বেগমের আইনজীবী শামিম আহমেদ বেনারকে বলেন, “আদালত মেয়র নির্বাচনে স্থগিতাদেশ দেয়নি ঠিকই। তবে ১৭ ডিসেম্বর পরবর্তী শুনানির পর জানা যাবে নির্বাচন বৈধ কিনা।”

তিনি বলেন, “রাজ্য সরকার সংশোধনী বিলের মাধ্যমে যেভাবে ১৯৮০ সালের পুর আইনে বদল এনেছে তা সম্পূর্ণ বৈআইনি।”

অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী মনে করেন, “ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় যেখানে লোকসভা ও বিধানসভার ক্ষেত্রে নির্বাচিত না হলেও মন্ত্রী হওয়ার চার মাসের মধ্যে নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ রয়েছে, সেখানে পুরসভার ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় হওয়ার কোনও কারণ নেই।”

তিনি বেনারকে বলেন, “বিরোধীরা না বুঝেই পুর আইন সংশোধনকে বেআইনি বলছেন। ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় যে ব্যবস্থা চালু রয়েছে তা পুরসভার ক্ষেত্রেও থাকা উচিত। সেটাই হয়েছে।”

কলকাতা পুরসভায় মুসলিম মেয়র

কলকাতা পুরসভার ৯৪ বছরের ইতিহাসে এর আগে আরও পাঁচ জন মুসলিম নেতা মেয়র হয়েছেন। তবে সেগুলি সবই হয়েছে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আগে।

ফিরহাদের আগে যারা কলকাতার মেয়র হয়েছেন তাঁরা হলেন এ কে ফজলুল হক (১৯৩৫-৩৬), এ কে এম জাকারিয়া (১৯৩৮-৩৯), আবদুর রহমান সিদ্দিকি (১৯৪০-৪১), সৈয়দ বদরুদ্দোজ্জা (১৯৪৩-৪৪) ও সৈয়দ মহম্মদ ওসমান (১৯৪৬-৪৭)। কিন্তু তারপর থেকে কখনো কোনও মুসলিম কলকাতার মেয়র পদে বসেননি।

কলকাতার মেয়র পদ থেকে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের পদত্যাগের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কলকাতার জন্য একজন মুসলিম মেয়রের দাবি উঠেছিল। ফিরহাদ হাকিম অবশ্য ১৯৮৫ সালে কলকাতা পুরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ২০১১ সালে তিনি রাজ্য বিধানসভার ভোটে জিতে মন্ত্রী হন।

বর্তমানে পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দমকলেরও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন ফিরহাদ। রাজনৈতিকভাবে মমতা ফিরহাদ হাকিমকে রাজ্যের কয়েকটি জেলা ছাড়াও প্রতিবেশি রাজ্য আসামে দলের সাংগঠনিক কাজ দেখার দায়িত্ব দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।