নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা তদন্তে হাইকোর্টের নির্দেশ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সিবিআই

যাজ্ঞসেনী চক্রবর্তী
2021.08.23
কলকাতা
নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা তদন্তে হাইকোর্টের নির্দেশ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সিবিআই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট চলাকালে অশান্ত পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম কেন্দ্রের বয়াল এলাকায় নিরাপত্তাকর্মীদের পাহারা। ১ এপ্রিল ২০২১।
[বেনারনিউজ]

গত এপ্রিল-মে মাসের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন-পরবর্তী হিংসা মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে সোমবার থেকে তদন্ত শুরু করেছে ভারতের উচ্চতম গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই)। মামলায় প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সিবিআই-কে ছয় সপ্তাহ সময় দিয়েছে হাইকোর্ট। 

সিবিআই ছাড়াও কলকাতার পুলিশ কমিশনারসহ উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকদের অধীনে চারটি বিশেষ তদন্তদল গঠনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। তাদেরকেও আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। 

গত ১৩ জুলাই রাজ্যের বিভিন্ন জেলা পর্যবেক্ষণ করে এই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি বিশেষ দল, ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। 

এই তদন্তকে ঘিরে নির্বাচনের আগে-পরে তুঙ্গে ওঠা কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যকার সংঘাত আবারো শুরু হবার আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। 

“নির্বাচনের আগে আমি লিখিতভাবে বলেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি (কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি) হারলেও তৃণমূল সরকারকে তারা কাজ করতে দেবে না। এই তদন্ত তারই প্রতিফলন,” বেনারকে বলেন দিল্লির সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ আদিত্য নিগম। 

“যদিও অন্য রাস্তা বেছে নিতে পারত কেন্দ্রীয় সরকার। মানবাধিকার কমিশনকে দিয়ে রিপোর্ট লিখিয়ে নেওয়ার সুবিধা হলো, আদালত তা উপেক্ষা করতে পারবে না,” বলেন তিনি। 

গত ২ মে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে রাজ্যের একমাত্র বিরোধী দল বিজেপি। 

“আমাদের প্রধান অভিযোগ ছিল পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হিংসার ঘটনায় মামলা দায়ের পর্যন্ত করেনি পুলিশ,” বেনারকে বলেন বিজেপির রাজ্য মুখপাত্র জয়প্রকাশ মজুমদার। 

২০১৮ সালের নভেম্বরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, রাজ্য সরকারের অনুমতি ছাড়া বাংলায় কোনোরকম তদন্ত করতে পারবে না সিবিআই। 

তবে আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের মতে, “ভারতের সংবিধানেই বলা আছে যে রাজ্য সরকারের আমন্ত্রণ ছাড়া তদন্ত করতে পারে না সিবিআই, সুতরাং এতে আলাদা করে ঘোষণা করার কিছু নেই।” 

“এই আইনের ব্যতিক্রম হবে একমাত্র যদি আদালতের নির্দেশ থাকে, যা এই ক্ষেত্রে হয়েছে, অথবা যদি আর্থিক অপরাধ সংক্রান্ত কোনও মামলা হয়,” বেনারকে বলেন অরুণাভ ঘোষ। 

অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ

গত ১৭ মে নারদ আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্ত করতে কলকাতায় এলে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয় সিবিআই। ছয় বছর আগের এই মামলায় ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে সেদিন গোয়েন্দা সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হন তৃণমূল কংগ্রেসের দুই মন্ত্রীসহ চার রাজনীতিবিদ, যার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠেন দলীয় সমর্থকদের একাংশ এবং সিবিআই-এর দপ্তরে ধর্না দেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। 

এদিকে সোমবার রাজ্যে সিবিআই-এর চার জয়েন্ট ডিরেক্টর পৌঁছানোর পর কলকাতায় নিজেদের মাঝে বৈঠক করেছেন বলে বেনারকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক। 

“ইতিমধ্যে রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজি) এই মামলায় তাঁর প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন,” জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা জানিয়েছি, হিংসার বহু মামলাই হয় পুরোপুরি সাজানো, না হয় অভ্যন্তরীণ গোলমালের ফল।” 

তৃণমূলেরও দাবী, অধিকাংশ হিংসার ঘটনাই বিজেপির অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল। এ প্রসঙ্গে দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বেনারকে বলেন, “মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট একেবারেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে হিংসার ভয়ে ঘরছাড়া বিজেপি কর্মীদের ঘরে ফিরিয়েছি। কোনো বিজেপি নেতা সেখানে ছিলেন না।” 

তবে হাইকোর্ট অবশ্য মানবাধিকার কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে। 

নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে তৃণমূলে ফিরেছেন বিজেপিতে যোগ দেওয়া সাংসদ মুকুল রায়, যিনি একসময় মমতার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। সেই সঙ্গে বিজেপি ছেড়েছেন বাংলা থেকে নির্বাচিত লোকসভা সদস্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়, যাঁর সঙ্গে প্রকাশ্যে এসেছে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ সভাপতি দিলীপ ঘোষের মতান্তর। এর ফলেই বিজেপির অভ্যন্তরে কলহ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। 

চলতি বছরের জুলাইতে বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক হিংসার একাধিক উদাহরণ দেখা যায়। সেইসব ঘটনার কেন তদন্ত হবে না কেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। 

“পঞ্চায়েত নির্বাচন হলে কি মানুষের জীবনের দাম কমে যায়? এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো উচ্চবাচ্য নেই কেন?” প্রশ্ন আদিত্য নিগমের। 

তিনি বলেন, “দিল্লির অভিজ্ঞতাও যদি ধরি, সেখানে (শাসকদল) আম আদমি পার্টির বিধায়কদেরও কোনো না কোনো মামলায় নিয়মিত ফাঁসানো হচ্ছে এবং এখন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতা চলে যাচ্ছে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের হাতে, যদিও বিধানসভার ৭০টি আসনের ৬২টি আম আদমি পার্টির হাতে।”

“অ-বিজেপি রাজ্য হলেই এই চিত্র মোটামুটি অবধারিত,” যোগ করেন আদিত্য। 

তবে বিজেপির জয়প্রকাশ মজুমদারের দাবি, আদালতের রায়ের সঙ্গেই প্রকাশিত ডিজি-র রিপোর্টে ১,৯৩৪টি হিংসার ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু গ্রেপ্তারের সংখ্যা মাত্র ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

“এসবের মধ্যে খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা রয়েছে, অথচ গ্রেপ্তারের সংখ্যা এত কম দেখে বোঝা যায় পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা,” বলেন জয়প্রকাশ মজুমদার। 

তিনি বলেন, “এছাড়াও ওই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, একটি ঘটনার ক্ষেত্রেও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেনি পুলিশ। অতএব শাসকদলের হয়েই কাজ করেছে তারা। বিজেপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই যদি হয়, পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করল না কেন?” 

কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে এই অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের পরিসমাপ্তি কীভাবে হবে, তা নিয়ে এখনই কিছু বলতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা। তবে অরুণাভ ঘোষের মতে, “দুই দলই গুণ্ডামি করছে, যার গায়ের জোর বেশি সেই জিতবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।