দেশ বাঁচানোর ডাক দিয়ে মমতার সত্যাগ্রহ

পরিতোষ পাল
2019.02.04
কলকাতা
190204_WB_mamata_1000.jpg দেশ বাঁচাও-এর ডাক দিয়ে কলকাতায় সত্যাগ্রহ শুরু করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকারের ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’র বিরুদ্ধে কলকাতায় ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সত্যাগ্রহ (ধর্না) চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার রাত থেকে তিনি এই সত্যাগ্রহ শুরু করেন।

একই সঙ্গে তিনি তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলন করার নির্দেশ দেন।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘সাংবিধানিক অধিকার, ব্যক্তিগত অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। সারা দেশ থেকে এই আন্দোলনে সমর্থন জানানো হয়েছে। যাঁরা গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক কাঠামোয় বিশ্বাস করেন, তাঁরাই এই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। এটা কোনও একার আন্দোলন নয়।’’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী এই ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে বর্ণনা করেন। তিনি বেনারকে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার জন্যই এই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন।”

সরকারে থাকাকালীন মমতার এটাই প্রথম রাজপথে ধর্না। বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন অবশ্য তিনি একাধিকবার এই ধরনের ধর্না ও অনশনে শামিল হয়েছিলেন।

বেআইনি অর্থলগ্নী সংস্থার বিষয়ে তদন্তে কলকাতা পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের আধিকারিকরা রবিবার সন্ধ্যায় কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে যেতেই পরিস্থিতি জটিল আকার নেয়।

কলকাতা পুলিশ সিবিআই আধিকারিকদের বাধা দেবার পাশাপাশি তাঁদের আটক করে স্থানীয় শেক্সপীয়র সরণী থানায় নিয়ে যায়। পরে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয় বলে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সাংবাদিকদের জানান।

তবে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) প্রবীন কুমার ত্রিপাঠি সাংবাদিকদের বলেন, “সিক্রেট অপারেশনে এসেছিল সিবিআই। কোনও কাগজপত্র ছাড়াই তারা কমিশনারের বাড়িতে ঢুকতে চেয়েছিল। তাই আটকে দেওয়া হয়েছে।”

সিবিআইয়ের যুগ্ম ডিরেক্টর (পূর্ব) পঙ্কজ শ্রীবাস্তব অবশ্য সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, “প্রযোজনীয় সব নথি নিয়েই তাঁর আধিকারিকরা পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন।”

রবিবার রাতেই নজিরবিহীনভাবে পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে ছুটে যান মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে তিনি পদস্থ পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন।

সেখান থেকে বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, “গত ১৯ জানুয়ারি কলকাতায় দেশের সব বিরোধী নেতাদের নিয়ে মোদী বিরোধী সমাবেশ করার পর থেকেই সাংবিধানিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা চলছে।”

এরপরেই তিনি ধর্মতলায় গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সুপার ইমার্জেন্সি’র বিরুদ্ধে ধর্নায় বসেন।

আদালতে সিবিআই

কলকাতা পুলিশের তদন্তের কাজে বাধা দেবার ঘটনার প্রতিকার চেয়ে সোমবার সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে সিবিআই দুটি বিষয় উল্লেখ করে। একটি আদালত অবমাননার প্রসঙ্গ, অন্যটি কলকাতার পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার চেষ্টার অভিযোগ।

প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিনি চরম রায় দেবেন, যাতে আক্ষেপ করতে হবে কলকাতা পুলিশকে।

সিবিআই অবশ্য এদিন আদালতে তদন্তে সহযোগিতার জন্য কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে আত্মসমর্পনের নির্দেশ দেবারও আরজি জানায়।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই সিবিআই ২০১৪ সাল থেকে বেআইনি অর্থ লগ্নী সংস্থা নিয়ে তদন্ত করছে।

এদিন লোকসভাতেও কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতের রেশ গিয়ে পড়ে। তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ সৌগত রায় অভিযোগ করেন, “সিবিআই, ইডির মতো সংস্থাকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে কেন্দ্রীয় সরকার। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করছে সরকার।” তিনি এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ব্যাখ্যা দাবি করেন।

কংগ্রেস সাংসদ মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, “বিরোধী দলগুলিকে শেষ করার চেষ্টা হচ্ছে। বিরুদ্ধ স্বর উঠলেই সরকার তা প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। রবিবার যা ঘটেছে তা শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটকেও এমন ঘটনা দেখা গিয়েছে। আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই কোনও দলই মাথা নোয়াবে না।”

তবে লোকসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, ‘‘উদ্ভূত এই পরিস্থিতি দুর্ভাগ্যজনক, নজিরবিহীন, অভূতপূর্ব। সাংবিধানিক কাঠমো এবং গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী ও অন্যান্য সংস্থার কাছেও উদ্বেগজনক। আমি আশা করি সব রাজ্য সরকারই কেন্দ্রীয় তদকারী সংস্থাগুলিকে সাহায্য ও সহযোগিতা করবে।’’

“এই সংঘাত চলতে থাকলে সাংবিধানিক কাঠামোই ভেঙে পড়তে পারে” বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাজনাথ সিং।

তথ্য লুকোবার অভিযোগ

ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সম্পাদক সায়ন্তন বসু বেনারকে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে পুলিশ কমিশনারকে বাঁচাতে তার বাড়িতে ছুটে গিয়েছেন তা নজিরবিহীন। তথ্য লুকোবার একটা চেষ্টা চলছে।”

তিনি বলেন, তদন্ত করতে বাধা দেওয়া, রাজ্যে বিরোধীদের কোনও মিটিং মিছিল করতে না দেওয়াই প্রমাণ করছে, রাজ্যে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে।”

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকার বলেন, “রাজীব কুমারের কাছে কী এমন তথ্য আছে যে, মমতাজি জান-প্রাণ এক করে দিচ্ছেন? মানুষ এর জবাব চাইছে।’’

তদন্তকারীদের সূত্রে বলা হয়, বেআইনি অর্থলগ্নী সংস্থা সারদা নিয়ে তদন্তের জন্য গঠিত বিশেষ তদন্তকারী টিমের প্রধান হিসেবে রাজীব কুমার বাজেয়াপ্ত করা একটি ডায়েরি ও কয়েকটি পেন ড্রাইভ সিবিআইকে মামলা হস্তান্তরের সময় তুলে দেননি। এগুলিতে অনেক প্রভাবশালীর অর্থ নেবার হিসেব ও নাম রয়েছে বলে অভিযুক্তরা তদন্তকারীদের বলেছেন।

কমিউনিষ্ট পার্টি মার্কসবাদীর (সিপিআইএম) নেতা সুজন চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে রবিবার থেকে যা যা ঘটেছে তার সবটাই অন্যায়, অনৈতিক ও অসাংবিধানিক।”

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের চার বছর পরেও বেআইনি অর্থলগ্নী সংস্থার তদন্তে সিবিআই পর্যাপ্ত গতি দেখায়নি কেন সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।

নির্বাচন কমিশনে বিজেপি

বিজেপি নেতাদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জনপ্রিয়তা দেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভয় পেয়ে গিয়েছেন। আর তাই সভা সমিতি করতে দেওয়া হচ্ছে না।

এই সব অভিযোগ নিয়েই সোমবার নির্বাচন কমিশনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন বিজেপির এক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল।

কমিশনের কাছে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, সেই দাবি জানিয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের মাটি শক্ত করতে ইতিমধ্যেই বিজেপি নির্বাচনী প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সহ কেন্দ্রেীয় নেতারা একাধিক নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে উৎখাতের ডাক দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।