বাংলাদেশে চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে

পুলক ঘটক
2017.12.08
ঢাকা
গবেষণা বলছে, নারীরা আত্মকর্মসংস্থানের দিকে ঝুঁকছেন। ঢাকায় নিজের দোকান সাজাচ্ছেন ফুল বিক্রেতা আমেনা। গবেষণা বলছে, নারীরা আত্মকর্মসংস্থানের দিকে ঝুঁকছেন। ঢাকায় নিজের দোকান সাজাচ্ছেন ফুল বিক্রেতা আমেনা। ০৮ ডিসেম্বর ২০১৭।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

গত তিন বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা কমে গেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।

সংস্থাটি বলেছে, ২০১৩ সালে বিভিন্ন খাতে নারী চাকরিজীবীর সংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ৫১ মিলিয়ন। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা কমে ৫ দশমিক ০৭ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। হিসাব অনুযায়ী তিন বছরে নারী চাকরিজীবীর সংখ্যা কমে গেছে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ।

সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারি বিভিন্ন জরিপ ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। তাঁরা দাবি করেছে, পরিবারের আয় বাড়ায় অনেক নারী এখন ঘরের বাইরে কাজ করতে চান না।

তবে শুধু আয় বাড়ার কারণেই কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কমে গেছে বলে মানতে রাজি নন বিআইডিএসের গবেষক ইকবাল হোসেন। তাঁর মতে, গার্মেন্টস শিল্পে নারীর কর্মের সুযোগ কমে যাওয়াই এর প্রধান কারণ।

‘শ্রমবাজার পরিস্থিতি ২০০৬ থেকে ২০১৬’ শীর্ষক এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন ইকবাল হোসেন। রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে গত বুধবার শুরু হওয়া ‘বিআইডিএস রিসার্চ অ্যালমানাক’ সম্মেলনে এ গবেষণাটি উপস্থাপন করা হয়।

ইকবাল হোসেন বেনারকে বলেন, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর সরকার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যাপারে খুব কঠোরতা অবলম্বন করে। ফলে নিরাপত্তাহীন ভবনে গড়ে ওঠা অনেক ছোট পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এতে নারীর কাজের সুযোগ কমে গেছে।

তবে এর সাথে দ্বিমত করে নারী নেত্রী খুশি কবির বলেন, এই গবেষণায় দেশের বাস্তব চিত্রের কতটা প্রতিফলন ঘটেছে সে বিষয়ে আমি সান্দিহান। বিষয়টি নিয়ে আরও বিস্তারিত ও গভীর স্টাডির প্রয়োজন রয়েছে।

“শিল্পোদ্যোক্তারা তৈরি পোশাক থেকে নিট ওয়ারের দিকে ঝুঁকে পড়ায় নারীর কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে—এ রকম তথ্য আমার কাছে আছে। কারণ নিট শিল্পে নারীর চেয়ে পুরুষ কর্মী বেশি নেওয়া হয়। নিটে যেসব যন্ত্র ব্যবহার করা হয় সেগুলো পরিচালনার জন্য পুরুষ কর্মীরা বেশি উপযোগী বলে শিল্প মালিকেরা মনে করেন। তবে তাদের এই ধারণা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে,” বলেন বেসরকারি সংস্থা নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির।

তিনি বলেন, “নারীর কর্ম সংস্থান প্রশ্নে গার্মেন্টস খাতে আউট সোর্সিং বন্ধ হওয়ার প্রভাব কতটা এটা আমার জানা নেই। আরও ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।”

অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বেড়েছে

প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহরাঞ্চলে যেসব নারী অস্থায়ী ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, পারিবারিক আয় বাড়ার পর তারা আর ওই সব কাজে থাকছেন না।

তা ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান ঢাকা থেকে দূরবর্তী এলাকায় চলে যাওয়ার কারণেও অনেকে নারী চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা নিজেদের মতো করে আয়বর্ধক পারিবারিক কাজে যুক্ত হচ্ছেন।

প্রায় একই ধরনের অভিমত তুলে ধরেন বিআইডিএসেরর আরেক গবেষক মিনহাজ মাহমুদ। তিনি বেনারকে বলেছেন, “অর্থনৈতিক অবস্থার অগ্রগতির ফলে অনেক নারী প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি ছেড়ে আত্মকর্মসংস্থানের দিকে ঝুঁকছেন। অন্তত ৩০ শতাংশ নারী বাইরের প্রতিষ্ঠানে চাকরি না করে বাসায় হাঁস মুরগি ও গবাদি পশু পালন কিংবা ছোটখাটো ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন।”

দিনমজুর হিসেবে কাজ করে জেসমিনের দৈনিক আয় ৩০০ টাকা। ঢাকা ০৮ ডিসেম্বর ২০১৭।
দিনমজুর হিসেবে কাজ করে জেসমিনের দৈনিক আয় ৩০০ টাকা। ঢাকা ০৮ ডিসেম্বর ২০১৭।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ
তবে এ বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিমীন মাহমুদ বেনারকে বলেন, “কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির কারণে অনেক নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। তারা চাকরি করার পরিবর্তে নিজের মতো করে বাঁচার চেষ্টা করেন। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ কমছে।”

“ফরমাল সেক্টরের চেয়ে ইনফরমাল সেক্টরে নারীর যৌন হয়রানির শঙ্কা বেশি। সুতরাং যৌন হয়রানির ভয়ে নারীরা কাজ ছেড়ে গৃহমুখী হচ্ছে এটা গ্রহণযোগ্য নয়,” বলেন খুশী কবির।

কৃষিখাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে

শিল্প ও সেবাসহ বিভিন্ন খাতে নারীর অংশগ্রহণ কমলেও কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিবিএসের জরিপ উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা বেড়ে ৬৩ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে।

এদিকে ২০১৩ সালে দেশের ১০০টি কর্মক্ষেত্রের মধ্যে ৩৩টি নারীর দখলে থাকলেও ২০১৬ সালে তা কমে ২৮টিতে দাঁড়িয়েছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়।

প্রতিবেদনের আরও বলা হয়েছে, চার বছর আগে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ নারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিল। ২০১৬ সালে তা কমে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশে নেমেছে।

গত তিন বছরে শুধু শিল্প খাতের চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।

২০১৩ সালে শিল্প খাতে নারীর কর্মসংস্থান ছিল ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা কমে ১৬ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে। সেবা খাতে ২০১৩ সালে নারীর অংশ ছিল ২৩ শতাংশ, তিন বছর পর তা কমে ২১ শতাংশ হয়েছে। উৎপাদন খাতে নারীর অংশ ২২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে গেছে।

কর্মসংস্থান বাড়বে বিশেষায়িত খাতে

গবেষণায় বলা হয়, আগামী কয়েক বছরে বিশেষায়িত কিছু খাতে নারীর কর্মসংস্থান বাড়ার সুযোগ আছে।

এ জন্য নারীদের বিশেষ দক্ষতা অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে পোশাক শিল্প, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, চামড়াজাত দ্রব্য প্রস্তুতকরণ শিল্প, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, ওষুধ শিল্প এবং খেলনা তৈরির মত উদীয়মান কিছু শিল্পে নারীর কর্মসংস্থান বাড়বে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।