নারী শ্রমিকের অভিবাসন বাড়ছে

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.04.04
160404-BD-women-employ-620.jpg ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশগামী নারী শ্রমিকেরা।৪ এপ্রিল ২০১৬।
বেনার নিউজ

সাতক্ষীরা জেলার বাসিন্দা আঞ্জুমান আরা বেগম।বছর দশেক আগে তাঁকে ত্যাগ করেন তার স্বামী। দুই মেয়েকে নিয়ে দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট হয়ে একদিন বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের সহায়তায় সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ নিয়েই গৃহশ্রমিক হিসেবে কুয়েত পাড়ি দেন আঞ্জুমান।এরপরের গল্পটা শুধুই সুখের।

আঞ্জুমানের পাঠানো অর্থে নতুন ঘর উঠেছে। মেয়েরা পড়ালেখা শিখেছে। বড় মেয়ে নিজে সংসারও হয়েছে।

‘সংসারে পুরুষ নেই বলে আর কোনো কষ্ট নেই। মেয়েদের নিয়ে সুখী সংসার আমার,” বেনারকে বলছিলেন কয়েক মাসের ছুটিতে দেশে আসা আঞ্জুমান।

ভাগ্য বদলানোর স্বপ্ন নিয়ে পুরুষের পাশাপাশি আঞ্জুমানের মতো বাংলাদেশের বহু নারীই বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রায় বিনা মূল্যেই বিদেশ পাঠানো হচ্ছে তাঁদের। যাকে নারীর ক্ষমতায়নের আরেকটি উজ্জ্বল দিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

তবে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর কবলে পড়ে পাচার কিংবা অপহরণের শিকারও হচ্ছেন অনেক নারী। বিশ্লেষকদের মতে, কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি বিদেশগামী নারীদের দক্ষ ও সচেতন করে তোলার মাধ্যমেই তাদের নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করা সম্ভব।

বাংলাদেশের নারী কর্মীরা মূলত গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। তবে এ দেশের প্রশিক্ষিত নার্সেরও বিভিন্ন দেশে চাহিদা রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই পুরুষ কর্মীরা বিদেশ যাওয়া শুরু করলেও নারী শ্রমিক পাঠানো শুরু হয় ১৯৯১ সালে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানায় যায়, সে বছর প্রথম বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যায় দুই হাজার ১৮৯ জন নারী কর্মী। পরের বছর এ সংখ্যা কিছুটা কমে আসলেও ধীরে ধীরে এ সংখ্যা বেড়েছে।

গত বছর এ সংখ্যা প্রথমবারের মত লাখ ছাড়িয়েছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গেছে এক লাখ ৩ হাজার ৭১৮ জন নারী, যা ২০১৪ সালের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি।

বিএমইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই বাংলাদেশি নারী কর্মীদের প্রধান গন্তব্য।এ পর্যন্ত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, ওমান, কাতার ও লেবাননে সবচেয়ে বেশি নারী কর্মী প্রবেশ করেছে।

১৯৯১ সালে মাত্র ২৯ জন বাংলাদেশি নারী সৌদি আরব যায়। যা পরবর্তীতে বাড়তে থাকে। দেশটিতে ব্যাপক চাহিদা থাকায় সম্প্রতি নারী কর্মী পাঠানোর বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়।

ওই চুক্তির আওতায় ২০১৫ সালেই সৌদি আরবে প্রায় ৫০ হাজার নারী কর্মী পাঠানোর কথা। তবে বছর শেষে দেশটিতে গেছে ২০ হাজার ৯৫২ জন নারী কর্মী। এ ছাড়া চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে সৌদি গেছে ১২ হাজার ৩১৬ জন।

বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছে ২৪ হাজার ৩০৭ জন নারী। একইভাবে ওমানে গেছে ১৬ হাজার ৯৮০ জন নারী কর্মী। তবে গত বছর সবচেয়ে বেশি নারী কর্মী গেছে জর্ডানে।মোট ২১ হাজার ৭৭৬ জন বাংলাদেশি নারী কর্মী নিয়েছে দেশটি।

সরকার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে

বিদেশগামী নারীদের দক্ষ করে তুলতে দেশে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য গন্তব্য দেশের ভাষা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজ শেখানো হয়। এ ছাড়া নারী কর্মীদের যাতায়াত খরচও নিয়োগকর্তা দিয়ে থাকেন। ফলে প্রায় বিনা খরচে বিদেশ যেতে পারেন তারা।

জানা যায়, দেশের প্রতিটি বিভাগেই বিদেশ গমনে ইচ্ছুক নারী কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সেসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম অপ্রতুল বলেও অভিযোগ রয়েছে।

বিএমইটি’র পরিচালক (প্রশিক্ষণ) খলিলুর রহমান বেনারকে বলেন, “বিদেশে দক্ষ শ্রমিকের বিপুল চাহিদার কথা মাথায় রেখে দেশের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বছরে ৫০ হাজারেরও অধিক নারী প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তারা সৌদি আরব, জর্ডান, লেবানন, দুবাই, আবুধাবি, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে গৃহশ্রমিকের কাজ করছেন।”

তিনি বলেন, নারী কর্মীদের জন্য বিদেশ যাওয়ার পথ অনেক বেশি সুগম। গার্মেন্টস কর্মীর প্রশিক্ষণও দেয় বিএমইটি। এ ছাড়া বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজনীয় খরচের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দিয়ে থাকে।

বিএমইটি পরিচালিত ঢাকার শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ ফওজিয়া শাহনাজ জানান, “এখানে সপ্তাহে ৩০০ নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ভাষা, যন্ত্রপাতির ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিপদে পড়লে করণীয় এবং আয় করা অর্থের সদ্ব্যবহারের বিষয়টিও প্রশিক্ষণের আওতায় রয়েছে।”

নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগ

সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে নারী কর্মীদের নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দেশে ফেরা অনেক নারীর মুখেই সেসব নির্যাতনের বর্ণনা পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “নারী শ্রমিক পাঠাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরকালে নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি জোর দেওয়া হয়। একটা সময় ছিল নারী কর্মীরা নিজেদের কাছে মোবাইল রাখতে পারতেন না। চুক্তির মাধ্যমে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিপদগ্রস্ত হলে করণীয় শেখানো হচ্ছে।”

বৈ​দেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান

প্রবাসী নারীরা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখছেন।

“এ সংখ্যা আরও বাড়াতে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারগুলো ছাড়াও নারী শ্রমিকদের জন্য নতুন বাজার খোঁজা হচ্ছে,” জানান প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী।

এ বিষয়ে  নারী অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনর (বমসা) পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বেনারকে বলেন, “একজন পুরুষ শ্রমিক নিজের আয়ের যতটুকু অংশ দেশে পাঠান তার চেয়ে বেশি পাঠান একজন নারী অভিবাসী কর্মী।”

তিনি জানান, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা এসব নারী কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। যে দেশ সঠিক কর্মপরিবেশ দিতে ব্যর্থ হবে, সেসব দেশে কর্মী পাঠানো বন্ধ রাখতে হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।