দেশে ফিরলেন সৌদি আরবে নির্যাতিত সেই সুমি

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.11.15
ঢাকা
191115_Female_Worker_Returns-Bangla_1000.JPG দেশে ফেরার পর পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে বেনারের কাছে সৌদি আরবে তাঁর ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছেন সুমি আক্তার। ১৫ নভেম্বর ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

সৌদি আরবে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে আকুতি জানিয়ে ফেসবুকে ভিডিও প্রকাশ করা সেই গৃহকর্মী সুমি আক্তার (১৮) শুক্রবার দেশে ফিরেছেন, পঞ্চগড়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে সুমীকে গ্রহণ করেছেন তাঁর বাবা।

শুক্রবার দুপুর নাগাদ সৌদি আরব থেকে ঢাকায় ফেরেন তিনি। অভিবাসন কর্মকর্তারা জানান, সুমির সাথে বাংলাদেশে ফিরেছেন আরও ৮৯ নারী শ্রমিক।

হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের নজর এড়িয়ে ভিন্ন গেট দিয়ে সুমিকে বাইরে নেন সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের কর্মকর্তারা। প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারি পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে তাঁকে পৌঁছে দেন।

পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ইউএনও সৈয়দ মাহমুদ হাসানের মধ্যস্থতায় বাবা রফিকুল ইসলাম এবং মা মল্লিকা বেগমের কাছে সুমিকে হস্তান্তর করা হয়। রফিকুল ইসলাম সুমি আক্তারকে ‘বুঝে পেয়েছি’ মর্মে সরকারি দলিলে সাক্ষর করেন।

সেখান থেকে বেরিয়ে বাবা-মায়ের সাথে বোদা উপজেলার পাঁচপীর ইউনিয়নের বৈরাতি এলাকায় নিজ বাড়িতে যান সুমি।

 

 

‘আমাকে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখে’

বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে সুমি আক্তার বলেন, “আমি যেভাবে নির্যাতন হয়েছি তা সবাই ভিডিওর মাধ্যমেই জেনেছেন। নতুন করে কিছু বলার নেই।”

তিনি বলেন, “দুই বছর আগে ঢাকায় গিয়েছিলাম। সেখানে আমার স্বামী নুরুল ইসলামের সাথে পরিচয় থেকে বিয়ে হয়। বিয়ের তিন-চার মাস পর স্বামীর পরামর্শে গত ৩০ মে আমি সৌদি আরবে যাই রূপসী বাংলা ওভারসিজ লিমিটেডের মাধ্যমে। সেখানে গিয়ে একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করি।”

“কিন্তু আমাকে গৃহকর্মী হিসেবে ভিসা দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য আমাকে রিয়াদে একটি বাসায় পাঠানো হয়,” জানান সুমি।

সুমি আক্তার বলেন, “রিয়াদে গিয়ে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হই। রিয়াদের যে মালিক ছিল, সে আমাকে দীর্ঘদিন একটি কক্ষে বন্দি করে রাখে। খাবার দিত না, মারধর করত।”

সুমি বলেন, “সেখান থেকে আমাকে না জানিয়ে ওই মালিকই নাজরানে ইয়েমেনের বর্ডারে আরেকজনের বাসায় প্রায় ২২ হাজার রিয়ালের বিনিময়ে আমাকে বিক্রি করে দেয়।”

সেখানে তাঁকে একটি কক্ষে আটকে রাখা হয় বলে জানান সুমি। তিনি জানান, এই পুরো সময়ে তাঁকে মাত্র এক মাসের বেতন বাবত ১৫ হাজার টাকা দিয়েছিল নিয়োগকারীরা।

নাজরানের মালিকও তাঁকে মারধর ও ‘অন্যান্য নির্যাতন’ করেছে জানিয়ে সুমি বলেন, “খাবার দিত না, দীর্ঘ সময় কাজ করাতো।”

নাজরানের মালিক তাঁর ফোন কেড়ে নেয় বলে জানান সুমি। তিনি বলেন, “আমি বাংলাদেশে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তারা তা করতে দেয়নি।”

ওই নারী জানান, “অনেক কান্নাকাটির পর আমার স্বামীর সাথে একটু কথা বলার সুযোগ দিয়েছিল। সেই সুযোগ আমি কাজে লাগাই।”

তিনি বলেন, “সেদিনও আমাকে অনেক মারধর করেছিল। আমি টয়লেটে গিয়ে আমার ওপর নির্যাতনের কাহিনী ভিডিও করে ফেসবুকে তুলে দেই। সেটা নিয়ে আমার স্বামী সাংবাদিকদের কাছে নিয়ে যায়।”

ভিডিওটি প্রচার হওয়ার পর থেকে তাঁকে উদ্ধার করার প্রক্রিয়া শুরু হয় বলে জানান সুমি।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ১৯৭৬ সালের পর ১৭৩টি দেশে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হয়েছে। তবে নারী কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৯১ সালে।

মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এ বছর ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের ৭৬ দেশে আট লাখ ৬৮ হাজার ৩৬৩ নারী কর্মী বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে সৌদি আরবে সর্বোচ্চ তিন লাখ ৩০ হাজার ৫৯০ জন নারী কর্মী পাঠানো হয়েছে।

নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধের দাবি

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বেনারকে বলেন, “সৌদি আরবে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের ওপর যে শারিরীক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন চলছে সেগুলো বন্ধ করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।”

তিনি বলেন, “সরকার ‍যদি এটা বন্ধ করতে না পারে তাহলে সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানো অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। কারণ এভাবে আমরা আমাদের মা-বোনদের যৌন নির্যাতকদের কাছে তুলে দিতে পারি না।”

চুন্নু বলেন, “আমার মতো আরও কয়েকজন সাংসদ সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানো বন্ধের পক্ষে মতামত দিয়ে সংসদে বক্তব্য রেখেছেন।”

প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান সাইফুল হক বেনারকে বলেন, “আমাদের হিসাবে যেসব নারী কর্মী সৌদি আরবে গেছেন, তাঁদের শতকরা ৭০ ভাগ বিভিন্ন ধরনের শারিরীক, মানসিক, যৌন ও অন্যান্য নির্যাতনের মধ্যে রয়েছেন।”

তিনি বলেন, “এগুলো বন্ধ করতে সরকারের উচিত সৌদি কর্তৃপক্ষের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা করা।”

“তবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করা যাবে না। এটা বন্ধ করা হলে নারী পাচার বেড়ে যাবে,” মনে করেন সাইফুল হক।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বেনারকে বলেন, সৌদি আরবে নারী শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা খুব বেশি নয়। তবে এরকম কিছু ঘটনাও দুঃখজনক। সরকার সেগুলো বন্ধ করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

মন্ত্রী ইমরান বলেন, “আগামী ২৬-২৭ নভেম্বর বাংলাদেশ-সৌদি যৌথ কারিগরি গ্রুপের সভা রিয়াদে অনুষ্ঠিত হবে। প্রবাসী কল্যাণ সচিব বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। ওই সভায় আমরা নারী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি উত্থাপন করে এ ব্যাপারে প্রতিকার চাইব।”

তিনি বলেন, “আশা করি, সৌদি সরকার নারী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।”

১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। গত বছর প্রবাসী কর্মীরা প্রায় সাড়ে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন। রেমিটেন্সের প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য এই অর্থ বছর দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার।

২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসীরা দেশে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন। গত অর্থ বছরে একই সময়ে এই অর্থের পরিমাণ ছিল তিন দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সরকার আশা করছে, এ বছর রেমিটেন্সের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।