সাধারণ ক্ষমায় স্বেচ্ছায় মালয়েশিয়া ছাড়ছেন এক লাখের বেশি অবৈধ শ্রমিক

নিশা ডেভিড ও নোয়া লি
2019.12.05
কুয়ালালামপুর
191205-MY-Immigration620.jpg ‘ব্যাক ফর গুড’ কর্মসূচির আওতায় সাধারণ ক্ষমার আবেদনের জন্য মালয়েশিয়ার পুত্রজায়া অভিবাসন সদরদপ্তরে অবৈধ বিদেশিদের লাইন। ১ আগস্ট ২০১৯।
[এস মাহফুজ/বেনারনিউজ]

মালয়েশিয়া সরকারের সাধারণ ক্ষমার সুযোগে স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে যাচ্ছেন এক লাখের বেশি অবৈধ শ্রমিক, যার মধ্যে রয়েছেন ৩০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি।

এইসব শ্রমিকদের বেশিরভাগের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়াতে দেশটিতে অবৈধ হয়ে পড়েছিলেন। এছাড়া রয়েছেন কোনো ধরনের বৈধ কাগজপত্র ছাড়া শ্রমিক। তাঁদেরকে চিরতরে মালয়েশিয়া ছেড়ে দেশে ফিরে যাবার জন্য গত জুলাইতে দেশটি ‘ব্যাক ফর গুড’ কর্মসূচি ঘোষণা করে।

বেনারের সংগ্রহ করা মালয়েশিয়ার অভিবাসন দপ্তরের নথি অনুযায়ী, সাধারণ ক্ষমার আওতায় চলতি বছরের আগস্টের এক তারিখ থেকে নভেম্বরের ২৮ তারিখ পর্যন্ত মোট এক লাখ ১১ হাজার ৭৩৬ জন অবৈধ বিদেশি আবেদন করেন, যার মধ্যে ৩০ হাজার ৯৮ জন বাংলাদেশিও রয়েছেন।

অভিবাসন দপ্তরের তথ্যমতে, এদের ৬১ হাজার ৪৩২ জনের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, বাকি পঞ্চাশ হাজার ৩০৪ জনের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই।

আবেদনকারীদের মধ্যে সবচে বেশি রয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক (৪২,২৭৯ জন)। এর বাইরে ভারত (১৯,৯৯৭), পাকিস্তান (৫,৭৫৫), মিয়ানমার (৫,৩৩২) ছাড়াও রয়েছেন নেপাল, শ্রীলঙ্কা, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন ও চীনের কিছু শ্রমিক।

“যে সব আবেদনকারী আমাদের নির্ধারিত সব শর্ত পূরণ করে আবেদন করেছেন এই সংখ্যাটি শুধুই তাঁদের,” বেনারকে বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের এক কর্মকর্তা।

মালয়েশিয়া সরকারের এই সাধারণ ক্ষমার মেয়াদ রয়েছে ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ পর্যন্ত। মেয়াদের শেষ দিকে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা।

‘ব্যাক ফর গুড’ কর্মসূচির আওতায় আবেদনকারীদের দেশে ফেরার বিমানের টিকিট কেটে ৭০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (প্রায় ১৪ হাজার বাংলাদেশি টাকা) জরিমানা দিয়ে আবেদন করতে হয়।

আবেদনের পর অভিবাসন দপ্তর থেকে ছাড়পত্র পেলে সাত দিনের মধ্যে অবৈধ বিদেশিদের মালয়েশিয়া ত্যাগ করতে হয়। এই কর্মসূচির আওতায় যারা মালয়েশিয়া ছাড়বেন, তাঁরা পরবর্তীতে আর কোনোদিন দেশটিতে প্রবেশের অনুমতি পাবেন না।

মালয়েশিয়া থেকে ফিরতে আগ্রহী অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বাড়তি ১৬টি বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।

টিকিট সংকটের কারণে সাধারণ ক্ষমার আওতায় ফিরতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের সহায়তার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।

এদিকে মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরেও যেসব অবৈধ শ্রমিক দেশটিতে থেকে যাবেন তাঁদের বিরুদ্ধে জানুয়ারি থেকে কঠোর অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের মহাপরিচালক খাইরুল জামি।

“কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পর যে সকল অবৈধ অভিবাসী ধরা পড়বেন তাঁদেরকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না,” বলেন তিনি।

সাধারণ ক্ষমার মেয়াদ শেষে দেশটিতে অবৈধ হিসাবে যারা ধরা পড়বেন তাঁদেরকে পাঁচ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত জরিমানার পাশাপাশি এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে বলে জানিয়েছেন দেশটির অভিবাসন কর্মকর্তারা।

মালয়েশিয়া থেকে অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের বিতাড়নের জন্য ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেও, দেশটির কর্মকর্তাদের মতে, বর্তমান সাধারণ ক্ষমাই চূড়ান্ত, এর পরে আর কোনো অবৈধ শ্রমিককে এই সুযোগ দেয়া হবে না।

এ আগের সাধারণ ক্ষমার আওতায় বিভিন্ন সময়ে দেশটি প্রায় আট লাখ চল্লিশ হাজার অবৈধ বিদেশি শ্রমিক বহিস্কার করে।

গত মার্চে প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন মতে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের শতকরা ১৫ ভাগ জুড়ে রয়েছেন বিদেশি শ্রমিক। এতে বলা হয়, মালয়েশিয়াতে বিদেশি শ্রমিকরা সাধারণত নিম্ন দক্ষতার কাজগুলো নিম্ন মজুরিতে করে থাকেন।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০১৭ সালে মালয়েশিয়াতে প্রায় ত্রিশ লাখ বিদেশি শ্রমিকের মধ্যে প্রায় বারো লাখ ছিলেন অবৈধ।

আটকে আছে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানো

এক বছরের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর আবারো মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর বিষয়ে দুই দেশ নীতিগতভাবে একমত হলেও তা আপাতত আটকে আছে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ সম্প্রতি মালয়েশিয়া সফর শেষে দেশে ফিরে জানিয়েছিলেন, ২৪ ও ২৫ নভেম্বর দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটির চতুর্থ বৈঠকের পর মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো পুনরায় শুরু হবে।

তবে নির্ধারিত সেই বৈঠকটি ‘মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ কারণে’ স্থগিত হয়ে গেছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

২০১২ সালে জিটুজি (গভমেন্ট টু গভমেন্ট) পদ্ধতিতে কর্মী পাঠাতে চুক্তি করে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ। ওই প্রক্রিয়া সফল না হওয়ায় ২০১৬ সালে পাঁচটি খাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বয়ে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে কর্মী নিতে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে দুদেশ। পাঁচ বছর মেয়াদী এই চুক্তির আওতায় লোক পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয় ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সিকে।

কিন্তু একটি সংঘবদ্ধ চক্রের অনৈতিক ব্যবসা পরিচালনার কারণে বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ করে দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ।

বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বন্ধ থাকা মালয়েশিয়ারা শ্রমবাজার পুনরায় উন্মুক্ত করতে দেশটির সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে সরকার। তারই অংশ হিসেবে গত ৬ নভেম্বর সরকারি সফরে মালয়েশিয়া যান প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ।

বাজারটি উন্মুক্ত করতে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলা সেগারানের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে মালয়েশিয়াতে প্রায় চার লাখ বৈধ বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন। অন্যদিকে অভিবাসন সংশ্লিষ্টদের মতে দেশটিতে অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন আরো এক থেকে দুই লাখ।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কুয়ালালামপুর থেকে আমিনা ফরিদ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।