সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিদায়
2023.04.12
ঢাকা
চির বিদায় নিলেন মুক্তিযোদ্ধা, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৮১ বছর বয়স্ক সুশীল সমাজের এই প্রতিনিধি।
তিনি একইসঙ্গে যেমন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমালোচক ছিলেন, অন্যদিকে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কট্টর সমর্থক। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এবং বাম রাজনৈতিক দলগুলো ভুল ধরিয়ে দিতেও তিনি কুণ্ঠা বোধ করতেন না।
বৃহস্পতিবার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। সেখানে সর্ব সাধারণ তাঁকে শ্রদ্ধা জানাবেন।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপি’র মহাসচিবসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন।
বাসস জানিয়েছে, বুধবার এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধ, ওষুধ শিল্প ও জনস্বাস্থ্য খাতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
তাঁর মৃত্যুকে অপূরণীয় ক্ষতি বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা।
যোগাযোগ করা হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “ডা. জাফরুল্লাহ দেখিয়ে দিয়েছেন রাজনীতি না করেও দেশকে অনেকভাবে দেওয়া যায়। উনি যেভাবে দিয়ে গেছেন, খুব কম মানুষই তা করেছেন।”
তিনি বলেন, “তিনি লন্ডনের আয়েশি জীবন পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের মানুষকে অতি অল্প খরচে এবং এমনকি বিনা খরচে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার প্রত্যয়ে কাজ শুরু করেন।”
অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, “উনি দেশের ‘দারিদ্র্য’ বিদেশিদের কাছে বিক্রি করে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটি করেননি।”
“এর পরিবর্তে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ যে মানুষের মানবাধিকার সেটি তিনি প্রতিষ্ঠা করতে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস এবং গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন; যেখান থেকে কম মূল্যে জনগণকে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয়,” যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, “দেশের ওষুধনীতি প্রণয়ন করতে সরকারকে সহায়তা করেছেন, যার মাধ্যমে আমাদের ওষুধ শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। দেশের মানুষ খুব সস্তায় ওষুধ পাচ্ছেন।”
তিনি বলেন, “তিনি কিডনি রোগীদের স্বল্প খরচে ডায়ালাইসিস সুবিধা দিতে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সুবিধা চালু করেছেন এবং সেখান থেকে তিনি নিজেও ডায়ালাইসিস নিতেন।”
অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, “আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ, আমলা, বিত্তবানরা সামান্য চোখের ফলোআপের জন্য ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর গিয়ে থাকেন। কিন্তু ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিদেশে চিকিৎসা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তাঁর নিজের হাসপাতালেই মারা গেছেন। একটি মানুষের পক্ষে আর কী ত্যাগ করা সম্ভব!”
“তবে দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের তাঁর কাছ থেকে কেউ শিখলেন না কীভাবে দেশকে ভালোবাসতে হয়,” বলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের রাউজানে ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
‘উনি কখনো নিরাশ হতেন না’
বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “জাফর ভাইয়ের সবচেয়ে বড়ো যোগ্যতা ছিল উনি কাউকে ছেড়ে কথা বলতেন না। এমনকি উনার নিজের মতাদর্শের মানুষকেও নয়। উনি ছিলেন মানুষের কণ্ঠস্বর। যে কোনো নাগরিক আন্দোলনে উনি ছিলেন সম্মুখ সারিতে। গত বছর ধানমন্ডির তেঁতুলতলায় মাঠ রক্ষার আন্দোলনে একজন ডায়ালাইসিসের রোগী হয়েও হুইল চেয়ারে বসে চলে এলেন মাঠে।”
রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, “বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না যে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার ও বীরাঙ্গনা নারীদের পুনর্বাসনের জন্য ধানমন্ডিতে কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। সেখানকার নারীদের তথ্য সংগ্রহের জন্য আমরা তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আমাদের জানানো হয় যে, ওইসব নারীদের সব তথ্য, পরিচয়ের কাগজপত্র ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।”
“এর কারণ ছিল যাতে ওইসব নারীদের পরিচয় জানাজানি না হয় এবং এই কাজটি করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। একজন চিকিৎসক হিসেবে তিনি ওই নারীদের চিকিৎসা দিয়েছেন এবং চিকিৎসকের ব্যবস্থা করেছেন। তাদের প্রায় সবাই সুস্থ হয়ে সমাজে ফিরে গেছেন,” বলেন তিনি।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও বেসরকারি সংস্থা উবিনীগের (উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা) নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার বুধবার বেনারকে বলেন, “জাফর ভাই ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী মানুষ। উনি কখনো নিরাশ হতেন না। উনি সব সময়ই বিশ্বাস করতেন যে, ঘুরে দাঁড়াতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “জাফর ভাইয়ের অন্যতম অবদান হলো বাংলাদেশের ওষুধনীতি প্রণয়ন। উনি যখন ওষুধনীতির কথা বলেন তখন হাতেগোনা কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে ওষুধ তৈরি করত এবং সেই সব ওষুধ তৈরি করত যেগুলোতে তাদের বেশি লাভ হতো।”
“ওষুধনীতির মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে অপরিহার্য ওষুধ তৈরির কথা বলা হয় এবং সেগুলোর দামের ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ রাখে সরকার। দেশীয় কোম্পানিগুলো যাতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা করেছিলেন জাফর ভাই। প্রযুক্তি হস্তান্তর করার ব্যবস্থা করা হয়, ফলে আজকে দেশের শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ ওষুধ বাংলাদেশে তৈরি হয় এবং আমাদের ওষুধ বিদেশে রপ্তানি হয়,” বলেন ফরিদা আখতার।
“তিনি শুধু ওষুধনীতি তৈরি করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি নিজেই গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯৮২ সালে ওষুধনীতি তৈরির সময় তাঁকে জেনারেল এরশাদের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো, সে কারণে তিনি সমালোচিত ছিলেন। তবে তিনি থেমে থাকেননি। ওষুধনীতি তৈরি করার পর স্বাস্থ্যনীতি করার কাজে হাত দেন। এই কারণে চিকিৎসকরা তাঁর বিরুদ্ধে চলে যান। উনার বিরুদ্ধে বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন) খুব আপত্তিজনক ভূমিকা পালন করা শুরু করে,” বলেন তিনি।
“শুধু স্বাস্থ্য খাতেই নয়, দেশের যে কোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে নির্ভয়ে সত্য কথা বলে যেতেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী,” যোগ করেন তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকে (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “উনার মধ্যে কোনো ভয় আমরা দেখিনি। সব সময় সত্য কথা বলে যেতেন। উনি ছিলেন দেশের সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর। সেই কারণে উনি দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সম্মানিত।”
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “উনাকে আমাদের আরও প্রয়োজন ছিল। দেশের এই ক্রান্তি লগ্নে তাঁর মতো একজন অকুতোভয় ব্যক্তির অনুপস্থিতি অনুভূত হবে।”
বিএনপি এক বিবৃতিতে জানায়, “মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর সেনানী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আজীবন দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণে অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টবাদী।”
“স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগণের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে স্বল্প মূল্যে চিকিৎসার জন্য গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী উন্নয়ন এবং সমাজ সংস্কারে ও বিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। রাষ্ট্রের সব সংকটে তিনি এগিয়ে এসেছেন অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে,” বলা হয় বিবৃতিতে।
বিএনপি বলছে, “ডা. জাফরুল্লাহ আওয়ামী সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপ এবং ভোটাধিকার হরণের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন এবং দুর্নীতি, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।”