বিনা বিচারে রোহিঙ্গা হত্যার অভিযোগ নাকচ করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
2020.09.17
ঢাকা ও কক্সবাজার
মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের মধ্যে কমপক্ষে একশ’ রোহিঙ্গা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর করা অভিযোগ নাকচ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন অধিকারকে উদ্ধৃত করে মঙ্গলবার দেয়া এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, ২০১৭ সালের পর থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত একশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সংগঠনটি প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
মানবাধিকার সংগঠনের এই হিসাবের সঙ্গে কক্সবাজার পুলিশের দেওয়া হিসাবের মিল রয়েছে, যদিও পুলিশ বলছে তারা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালের ৪ মার্চ থেকে এ বছর পয়লা আগস্ট পর্যন্ত জেলায় ২৭০টি ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে দুই নারীসহ ১০৪ জন রোহিঙ্গা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “কক্সবাজার এলাকায় যেসব রোহিঙ্গা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে, এগুলোর কোনটিই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নয়।”
তিনি আরও বলেন, “এরা মূলত সশস্ত্র ইয়াবা চোরাকারবারি। তারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।”
মন্ত্রী বলেন, “আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাজ সীমান্তের ওপার থেকে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানো। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা যখন ইয়াবা চোরাকারবারিদের প্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা করেন, তখন তাদের ওপর গুলি চালানো হয় এবং আমাদের বাহিনী পাল্টা গুলি চালালে তারা প্রাণ হারায়।”
মন্ত্রী আরও বলেন, “আবার আমাদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে গেলে অপরাধী রোহিঙ্গারা তাদের ওপর গুলি চালায়, এ সময় পাল্টা গুলিতে হতাহতের কিছু ঘটনা ঘটেছে ।”
আসাদুজ্জামান খান বলেন, “আমরা প্রত্যেকটি প্রাণহানির ঘটনা তদন্ত করে দেখি। যদি কেউ আইন লঙ্ঘন করেছেন বলে তদন্তে উঠে আসে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়।”
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে দেয়া অধিকারের এ-সংক্রান্ত তথ্য যাচাইয়ের জন্য বেনারের পক্ষ থেকে ইমেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংগঠনটির বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে পুলিশি অপারেশনে প্রাণহানির সংখ্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে সরকারের সাথে মতানৈক্য হয় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের। মিথ্যা তথ্য দেয়ার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ও আইনজীবী আদিলুর রহমানকে কারাগারে যেতে হয়। ২০১৮ সালের নভেম্বর নির্বাচন কমিশন অধিকারের নিবন্ধন বাতিল করে। এরপর থেকে সংগঠনটির কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়া হয়।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “অধিকারকে উদ্ধৃত করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে ২০১৭ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১০০ জন রোহিঙ্গা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আমি মনে করি এই সংখ্যাটি ঠিক আছে।” তিনি বলেন, “সরকার রোহিঙ্গাদের নিহত হওয়ার ঘটনাকে ক্রসফায়ার বলছে। প্রকৃতপক্ষে এগুলোর কোনটিই সত্যিকারের ক্রসফায়ারের ঘটনা নয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।”
নূর খান আরও বলেন, “আমরা কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তদন্ত করে এমন ঘটনাও পেয়েছি যে, একজন বাঙালিকে হত্যার পর বলা হয়েছে সে রোহিঙ্গা।” তাঁর মতে, “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো ইয়াবা পাচারের ঘটনার সাথে যুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাদের গুলি করে মেরে ফেলতে হবে। বিচার করা তো যায় এবং দেশে বিচারিক প্রক্রিয়া চালু আছে।”
নূর খান বলেন, “রোহিঙ্গা অথবা বাঙালি যে জাতিসত্তার হোক না কেন কাউকে হত্যা করা যাবে না। একজন সন্দেহভাজন অথবা একজন অপরাধীকে মেরে ফেলা বাংলাদেশের সংবিধানসহ সকল আইন ও মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী।”
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “ক্রসফায়ারের নামে রোহিঙ্গাদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হচ্ছে, এটি সত্য। তাদের ইয়াবা পাচারকারী বলে আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে “
তিনি বলেন, “তবে, পুলিশের হাতে বিচারবহির্ভূতভাবে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহত হওয়ার পর কক্সবাজারে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।”
এর আগে শুধু এক যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক হত্যার জেরে গত বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পাঁচ রোহিঙ্গা পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়।
টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের মো. শফি বেনারকে বলেন, “জুলাই মাসের শেষের দিকে আমার নিরপরাধ ছেলেকে (রশিদ উল্লাহ ২৮) দোকান থেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর তাকে ডাকাত বানিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়।” তিনি বলেন, “এর আগে প্রায় এক বছর আগে কোনো কারণ ছাড়াই পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায়। প্রায় ৪০ দিন আটকে রাখার পর আমাকে ডাকাতি মামলায় আদালতে চালান দেওয়া হয়।”
তবে কক্সবাজার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গাদের অনেকেই নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে মারা গেছেন। আর যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে রোহিঙ্গা ডাকাতেরা। এ ঘটনা ছাড়াও অনেক রোহিঙ্গা হত্যা, ডাকাতি, মাদক চোরাচালানসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত।
তিনি বলেন, যারা এ পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে তাদের সবার বিরুদ্ধে ডাকাতি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া নিহত রোহিঙ্গাদের সবার বিরুদ্ধে থানায় ডাকাতি, হত্যা, মাদকসহ একাধিক মামলা রয়েছে।