টানা অগ্নিসংযোগে বিপর্যস্ত গণপরিবহন ও সেবা খাত

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.11.29
ঢাকা
টানা অগ্নিসংযোগে বিপর্যস্ত গণপরিবহন ও সেবা খাত ঢাকার তাঁতিবাজার মোড়ের কাছে একটি বাসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন দমকল বাহিনীর কর্মীরা। ৮ নভেম্বর ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে সরকার-বিরোধী দলগুলোর টানা হরতাল ও অবরোধ চলাকালে ২২০টিরও বেশি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ হয়েছে বলে বুধবার জানিয়েছে দেশটির ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর। এই সহিংসতার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে গণপরিবহন খাতের উপর। 

এই খাতে কর্মরতরা বলছেন, মহাসড়কে গাড়ি বের করলে অগ্নিসংযোগের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকায় দূরপাল্লার বেশিরভাগ পরিবহন সেবা বন্ধ রয়েছে। ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে গাড়ি বের করলেও যাত্রী পাওয়া যায় খুব কম। ফলে অনেক শ্রমিক ও কর্মীর জন্য জীবনধারণ করাই কঠিন হয়ে উঠছে।  

“আগুনের ভয়ে বেসরকারি মালিকেরা গাড়ি বের করতে চাচ্ছেন না। কোনো কোনো মালিক ব্যাংক ঋণের কিস্তি, অফিসের ভাড়া বা গাড়ির স্টাফদের বেতনের চিন্তায় গাড়ি বের করলেও রাস্তায় যাত্রী খুবই কম। তাই গাড়ি বের করলেও খুব একটা লাভ নেই।  বরং আছে গাড়ি পুড়ে যাওয়ার মতো বড় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা,” বেনারকে বলছিলেন পরিবহন কর্মী মোহাম্মদ আলম। 

ঢাকা-বগুড়া সড়কে চলাচল করে শাহ ফতেহ আলী পরিবহনে কাজ করা আলম আরও জানান, ২৮ অক্টোবর থেকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর হরতাল ও অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে তাঁর নিজের দৈনন্দিন আয় নেই বললেই চলে। 

তিনি বলেন, “পরিবারের সদস্য ছয়জন। কীভাবে চলবো বলেন? এক মাস ধরে গাড়ি বন্ধ। সপ্তাহে তিন-চারদিন কাজ পেতাম। তাতেই চলতে অনেক কষ্ট হতো। এখন তো না খেয়ে থাকার অবস্থায় চলে গেছি।” 

বাংলাদেশে হরতাল বা অবরোধ চলাকালে বাস, ট্রাক বা মানুষের ব্যক্তিগত চলাচলের গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। ২০১৩-১৪ সালে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের সময়ও একই ঘটনা ঘটে। তারও আগে শাসক দল আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায়ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছিল। তবে কোনো পক্ষই সচরাচর এই ধরণের ঘটনার দায় স্বীকার করে না। 

সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে মন্ত্রী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানরা প্রায়ই বলছেন, জোর করে জনগণের উপর নিজেদের আন্দোলন চাপিয়ে দিতে বিরোধীরা গাড়ি পোড়াচ্ছে। আবার বিএনপির পক্ষ থেকে প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ সম্মেলনে বলা হচ্ছে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের উপর দমনপীড়নের অজুহাত হিসেবে সরকারের লোকজন গাড়িতে আগুন দিচ্ছে। 

“বাংলাদেশের রাজনীতিতে হরতাল-অবরোধ একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এটি মোটেও নতুন কিছু নয়। নির্বাচনের আগে এগুলো হয়। এখনকার সরকারি দলও দিনের পর দিন হরতাল পালন করেছে,” বেনারকে বলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. সাখাওয়াত হোসেন সায়ান্থ।

তাঁর বক্তব্য, বিরোধী দলগুলোর দাবির প্রতি জনগণের সমর্থন থাকলেও, তাদের কঠোর কর্মসূচির কারণে জীবনজীবিকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে নিজ থেকে এই ধরণের কর্মসূচি পালন করার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অনীহা থাকে। আবার সেই কারণেই জোর করে এসব কর্মসূচি কার্যকর করার চেষ্টা থাকে রাজনৈতিক দলগুলোর।

সাখাওয়াত বলেন, “হরতাল-অবরোধে মানুষের কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু বিএনপির হাতে আর কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। এই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার আর কোনো হাতিয়ার নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশে এটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।”

সরকারের কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, অগ্নিসংযোগের ঘটনা সত্ত্বেও দেশজুড়ে যানচলাচল প্রায় স্বাভাবিক।

বাংলাদেশের পরিবহন ও শ্রমিক খাতে আলাদা প্রভাব রয়েছে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খানের। তিনি বলেন, “বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধ মানুষ প্রত্যাখান করেছে। সেই কারণে তারা বাসে, ট্রাকে আগুন দিয়ে হরতাল-অবরোধ পালন করতে মানুষকে বাধ্য করার চেষ্টা করছে।”

তাঁর বক্তব্য, “সংখ্যা কিছুটা কম হলেও সারাদেশে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। ঢাকার রাস্তায় তো রীতিমতো যানজট।”

কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। যেমন, নওগাঁ-বগুড়া-ঢাকা রুটে স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক প্রায় ৩০টি গাড়ি চলাচল করে; কিন্তু বুধবার সারাদিনে ছেড়ে গেছে মাত্র পাঁচটি গাড়ি। 

সেবাখাতই ক্ষতিগ্রস্ত বেশি

ঢাকার শীর্ষস্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বেনারকে বলেন, বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের আগে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচির কারণে খেটে খাওয়া মানুষজন সবার আগে বিপদে পড়েন।

তিনি বলেন, “হরতাল-অবরোধে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের সেবাখাত যেখানে আমাদের সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান। সেবাখাতের মধ্যে রয়েছে পরিবহন, পর্যটন, ছোটখাটো দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।”

“সেবাখাত মূলত মানুষের চলাচলের ওপর নির্ভরশীল। হরতাল-অবরোধের কারণে মানুষের চলাচল কমে গেলে সেবাখাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

ঢাকার মিরপুরে আড়তদার জহির উদ্দিন বেনারকে বলেন, সড়ক চলাচল সীমিত হয়ে যাওয়ায় পণ্য পরিবহনের ব্যয় নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। 

“হরতাল-অবরোধের আগে ঝিনাইদহ থেকে একটি ট্রাক ঢাকা আসতে সর্বোচ্চ ভাড়া নিত ১৫ হাজার টাকা। এখন সেই ভাড়া ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এ কারণে অনেক আড়তদার মালামাল আনছেন না,” বলেন তিনি।

পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির আঁচ লেগেছে ভোক্তা পর্যায়েও। 

মিরপুর-১২ এলাকার শাক-সবজি বিক্রেতা পলাশ মাহমুদ বেনারকে বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে ঢাকার বাইরে থেকে মালামাল আসা কমে গেছে – ফলে পণ্যের দাম গেছে বেড়ে।

পলাশ বলেন, “বেশি দামে কিনলে তো বেশি দামে বিক্রি করবো। ক্রেতাদের সেই বাড়তি দাম দিতে হবে।”

অর্থনীতিবিদ গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন সেবাখাতের প্রভাব শুধু পরিবহন সংকট জনিত মুল্যবৃদ্ধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। 

“এর পরবর্তী ধাপ কর্মী বা শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়। আবার অনেক সময় ব্যবসা সঙ্কুচিত করা হয়। এমনকি ব্যবসা বন্ধও হয়ে যায়।”

“সাধারণত নির্বাচন হয়ে গেলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায়। তবে নির্বাচনের পরেও যদি এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে, সেক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতি বড় ধরণের ক্ষতির মুখে পড়ে যাবে,” যোগ করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।