বাংলাদেশ নিয়ে ‘বোকার স্বর্গ যাত্রায়’ ভারত
2025.01.22

প্রবল গণ-আন্দোলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হওয়ার পরই আমি প্রথমবারের মতো ভারতের বৈশ্বিক হিন্দু জাতীয়তাবাদী অনলাইন ট্রল বাহিনীর মুখোমুখি হই। তাদের কৌশল ও পদ্ধতি তখনই আমার চোখ খুলে দেয়।
ভারত দীর্ঘদিন ধরে হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে আসছিল এবং তিনি ৫ আগস্ট তড়িঘড়ি করে ঢাকা ছাড়লে তাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তও দ্রুতই নিয়েছিল।
এর পরপরই ভারত উদ্বেগ জানাতে থাকে, হাসিনার প্রস্থানের পর বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে। শুরু হয় অনলাইনে অপপ্রচার। বেশ কিছু স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেকিং দল এসব দাবিকে ভিত্তিহীন বলে চিহ্নিত করা সত্বেও প্রচারণা অব্যাহত থাকে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মোহাম্মদ ইউনূস ভারতকে জানিয়েছেন, কিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তবে তা সাম্প্রদায়িক নয়।
ইউনূস প্রশাসন ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী; তবে ভারত থেকে ছড়ানো বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছে।
তবুও, ভারতীয় গণমাধ্যমের সদস্যরা - যাদের বেশিরভাগই মোদী সরকার লাফ দিতে বললে "কত উঁচুতে লাফাতে হবে” জিজ্ঞাসা করে লাফায় - এই উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তারা দাবি করছে ইউনূস সরকার নাকি বাংলাদেশে ইসলামী চরমপন্থীদের শক্তিশালী করেছে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।

ভারত ও প্রবাসী ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো ভারত সরকারের মনোভাব প্রতিফলিত এবং প্রভাবিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে হেয় করার এবং বিদেশী রাষ্ট্রের নীতি-কৌশলকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে আগ্রাসী এবং বিভ্রান্তিকর প্রচারণা শুরু করেছে।
"ইন্টারনেট হিন্দু" নামে পরিচিত এই ``কীবোর্ড যোদ্ধারা’’ প্রধানত মোদী সরকারের বিজেপি এবং তার জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ ``হিন্দুত্ববাদের”অনুসারী।
এদের একমাত্র লক্ষ্য হিন্দুত্ববাদের ভিত্তিতে ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে দেওয়া - এবং প্রায়শই সহিংসতা উস্কে দেয়া। এটি এমন এক মতাদর্শ- যা মনে করে ভারত ও হিন্দুধর্ম সমার্থক এবং সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষ দেশটিকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা উচিত।
তারা বাংলাদেশের কথিত "হিন্দু-বিরোধী সহিংসতা"র ভুয়া ছবি ও সংবাদ ছড়িয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলছে।
`ভারতবিরোধী এজেন্ট’ হওয়ার অভিযোগ
হাসিনা সরকারের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদের একজন সোচ্চার সমালোচক হিসেবে আমি ৫ আগস্টের পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছিলাম।
এতে আমি হিন্দুত্ববাদী ডানপন্থীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে যাই। তারা আমাকে "গণহত্যার সহযোগী" এবং ভারতবিরোধী " ডিপস্টেট" এজেন্ট বলে অভিহিত করে।
এমনকি আমাকে বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দলের বেতনভোগী কর্মচারী হিসেবে দেখানো এবং আরও জঘন্য গুজব ও কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছে।
অনেকে এসব আক্রমণ এড়িয়ে যান বা চুপ থাকেন। তবে আমি তাদের মিথ্যা উন্মোচন ও সত্য প্রকাশ করার পথে হেঁটেছি। এতে আমি অনলাইনে কিছু সমমনা মানুষের সমর্থন পেয়েছি।
হাসিনার সমর্থকরা তাদের পুরনো দাবি পুনরায় চালিয়ে যাচ্ছে। বলছে, একমাত্র তিনিই ইসলামপন্থীদের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করছেন। যদিও বাস্তবতা হলো, অধিক রক্ষণশীল ইসলামী দলগুলো কখনও ভোটারদের ব্যাপক সমর্থন পায়নি।
এই প্রচারণার লক্ষ্য হলো হাসিনা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেওয়া। তারা বয়ান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশের রহস্যময় “ডিপ স্টেটের”চালকরাই হাসিনাকে সরিয়েছে।
আংশিকভাবে হলেও, এই আখ্যানটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার সময় তাঁর সমর্থন অর্জনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল।

বাংলাদেশে কথিত হিন্দু "গণহত্যা" সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রচারের ফলে সহিংসতার প্রকৃত ঘটনা চিহ্নিত করা এবং দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
ভারতের চলমান চাপ বাংলাদেশে একটি তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। একজন জনপ্রিয় অনলাইন ভাষ্যকার “হটাও ভারত” প্রচারণা শুরু করেছেন, যা উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন পেয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে কট্টর ভারতবিরোধীদের প্রচারণার চাপে মধ্যপন্থী কণ্ঠস্বর হারিয়ে যাচ্ছে। এই ফাঁকে এগিয়ে এসেছে পাকিস্তান ও চীন। তারা বাংলাদেশের নতুন সরকারকে আলিঙ্গন করার জন্য কূটনৈতিক, সামরিক এবং বাণিজ্যিক যোগাযোগ জোরদার করেছে।
মোদি সরকারের উচিত হিন্দুত্ববাদী ট্রল বাহিনীর উপর লাগাম টানা, কারণ এই বিপজ্জনক প্রচারণা দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে ।
এদিকে ভারতীয় সরকার, গণমাধ্যম, নীতিনির্ধারনী প্রতিষ্ঠান এবং ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর গৃহিত পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের ভেতরও ভারত-বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষত যারা গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, তাদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাবকে উস্কে দিয়েছে।
এই মনোভাব প্রাণঘাতী সহিংসতার জন্ম দিয়েছে। একজন হিন্দু নেতার গ্রেপ্তারবিরোধী বিশাল বিক্ষোভের মধ্যে বাংলাদেশে একজন আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। তবে তা ভারতের কূটনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে কীভাবে সহায়ক হবে তা বলা মুশকিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর বিজয়ের স্মরণে ভারতে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩। [দিব্যাংশু সরকার/এএফপি]
৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি আমাকে আমেরিকান পুলিৎজার বিজয়ী ইতিহাসবিদ বারবারা টুচম্যানের "মার্চ অফ ফোলি" বা “বোকার স্বর্গে যাত্রার” স্ববিরোধী পরিপ্রেক্ষিত মনে করিয়ে দেয়, যেখানে সরকারগুলি তাদের নিজস্ব স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে।
তবুও আমার বিশ্বাস ভারত এবং বাংলাদেশের সামনে এই পরিস্থিতি এড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
শুরুটা উপর থেকে হতে হবে। উভয় সরকার তাদের সমর্থকদের বার্তা দেবে যে দুই প্রতিবেশী দেশ নতুনভাবে শুরু করে একে অপরকে উপকৃত করতে পারে।
এটি উভয় দেশের জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হবে এবং তাদের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের জন্য ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে অভিন্ন স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করা সহজ করবে।
লেখক পরিচিতি: জন ড্যানিলোভিচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, যার দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। কূটনৈতিক জীবনে তিনি ঢাকায় তিনবার দায়িত্ব পালন করেছেন, যার মধ্যে মার্কিন দূতাবাসে ডেপুটি চিফ অফ মিশন হিসেবে দায়িত্ব পালনও রয়েছে। এখানে প্রকাশিত মতামত তার নিজস্ব এবং তা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বা বেনারনিউজের অবস্থান প্রতিফলিত করে না।