বাংলাদেশের ধর্ম ও রাজনীতি: একটি লণ্ডভণ্ড পরিবারের কাহিনী

Benar 10-year logo rec.png

বেনারনিউজ যখন ২০১৫ সালের মার্চে প্রকাশনা শুরু করে, বাংলাদেশ তখন একুশে বইমেলায় বাংলাদেশি-আমেরিকান লেখক অভিজিৎ রায়ের নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে উত্তাল। ২০১৬ সালের মে মাসের মধ্যে মুক্তমনা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ইসলামি মৌলবাদীদের হাতে লেখক-প্রকাশকসহ আটজন খুন হন। শুরু থেকেই বেনারনিউজ বাংলাদেশের 'ব্লগার হত্যা ' র সংবাদগুলো গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করে। ওই বিপজ্জনক সময়ে প্রাণভয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে আসা দুজন লেখক ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বেনারনিউজের ওয়াশিংটন টিমে যোগ দেন। গত এক দশকে নিজের পারিবারিক জীবনের ওপর ওইসব দিনের ঘটনাক্রমের গুরুতর প্রভাব সম্পর্কে লিখেছেন বেনারনিউজের মাহবুব লীলেন, যেখানে উঠে এসেছে মুক্তচিন্তা ও মুক্তমত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার চিত্র।

কেইট বেডাল, ম্যানেজিং এডিটর।

“তোর সাথে আমার আর দেখা হবে না বাজান। বাংলাদেশ তোর ফিরে আসার উপযোগী হওয়া পর্যন্ত আমি বাঁচব না। …সুতরাং এটাই শেষ দেখা। যা বেঁচে থাক।”

দেশ ছাড়ার আগে বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে ঢাকা থেকে সিলেট যাবার পর কথাগুলো বলছিলেন আমার বাবা শফিক আহমেদ। চল্লিশ বছরের বেশি চা বাগানে চাকরি করে বড়ো করা তাঁর পাঁচ ছেলে আর দুই মেয়ের ভেতর আমি দ্বিতীয়।

ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা যখন বাংলাদেশে একের পর এক মুক্তমনা লেখক-প্রকাশকদের টার্গেট করে হত্যা করছিল, তখন ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রাণের ভয়ে দেশ ছাড়ি আমি। তারপর আর দেশে যাওয়া হয়নি।

আমার বাবাকে কেউ কোনোদিন ধর্ম করতে দেখেনি, ধর্ম নিয়ে কথাও বলতেন না তিনি। অন্যদিকে আমার মা মনোয়ারা বড়ো ভূঁইয়া ধার্মিক। আর আমরা সাত ভাইবোনের একেকজন একেকরকম, যার এক মাথায় আছি ঈশ্বরবিশ্বাসহীন আমি, অন্য মাথায় আছে অক্ষরে অক্ষরে মুসলমান ধর্মীয় রীতি পালন করা আমার এক ভাই।

“কে কোন পথ নেবে সেটা তার ইচ্ছা। আমার কাজ ছেলেমেয়ের সঙ্গে থাকা। আমি আছি,” বলতেন বাবা।

বাবার সাথে আর দেখা হয়নি আমার। আমি চলে আসার চার বছর পর বাবা মারা যান।

photo 2.jpg
আমার বাবা শফিক আহমেদ (মাঝখানে) ঢাকায় তাঁর বড়ো মেয়ে রোমানা কিরণের (বামে) বিয়ের দিন দুই মেয়ে কিরণ ও ফারজানা জেরীনের সাথে। ৫ আগস্ট ২০০৯। (পারিবারিক ছবি/মাহবুব লীলেন)

বাংলাদেশে ধর্মীয় নিয়মের বাইরে বিয়ে করা প্রায় অসম্ভব। আদালতে গিয়ে বিয়ে করলেও ধর্মের উল্লেখ থাকতে হয়। নিজেদের সম্পূর্ণ ধর্মমুক্ত রাখতে ২০০৯ সালের অক্টোবরে আমি আর দিনা ফেরদৌস নিজেদের তৈরি একটি চুক্তিপত্র রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করি। আমার সেই ধর্মহীন বিয়ের এক সাক্ষী ছিলেন আমার বাবা।

আমার এক বোন যখন চার্চে গিয়ে এক খ্রিস্টান ছেলেকে বিয়ে করল, সেখানেও সাক্ষী ছিলেন বাবা। আমার ধার্মিক ভাই যখন বিয়ে করে লোকজনকে খেজুর খাইয়ে সুন্নতি নিয়মে দোয়া আয়োজন করল, সেখানেও ছিলেন তিনি। এক ভাই যখন কাউকেই না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলল, তিনি বললেন, “ঠিক আছে।”

আমাদের পরিবারটা ছিল ঠিক এই রকম। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মত ও পথের সাত ভাইবোনের এক প্রাণবন্ত উদার পরিবার। অথচ এই ধর্মীয় আর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই একের পর এক দুর্গতি নেমে আসতে লাগল পরিবারে।

photo 3.jpg
জীবন থেকে ধর্মীয় পরিচয় সরাতে নিজেদের তৈরি করা এক সাধারণ চুক্তিপত্র রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করি দিনা আর আমি। সেই স্ট্যাম্পের ছবি। (ছবি: মাহবুব লীলেন)

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের (২০০৯-২০২৪) তথ্যপ্রযুক্তি আইন ধর্ম সমালোচনাকে জামিন অযোগ্য ধারায় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। সরকারের প্রশ্রয়ে ২০১৩ সাল থেকে ইসলামি মৌলবাদীরা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সেকুলার ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের আক্রমণ ও হত্যা করতে থাকে।

শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার এখন অতীত। কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ঘটা শুরু করল শত শত আক্রমণ ও মামলা দিয়ে হয়রানির ঘটনা। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় ঘটতে থাকল বেকারত্ব ও চাকরিহীনতা, যার সরাসরি শিকার আমার পরিবার।

“আগে ভাবতাম বাচ্চাগুলো বড়ো হয়ে গেলে আমার দুঃখ চলে যাবে। কিন্তু পিঠাপিঠি সাতটা বাচ্চা বড়ো করার পর ভয়ে, আতঙ্কে বাচ্চাদের পালিয়ে বেড়ানো দেখে আমাকে জীবন কাটাতে হবে কল্পনাও করিনি।”

এই দুঃখ নিউ ইয়র্কে বসবাস করা আমার ৭৫ বছর বয়স্ক মায়ের, যিনি ৫৩ বছর সংসার করে বিধবা হয়ে এখনো একা থাকার কৌশল শিখছেন।

এ মৃত্যু আমারও

আমার পরিবারের দুর্গতি শুরু হয় আমাকে দিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে আমি ধর্মবিশ্বাসহীন মানুষ। আমার লেখালেখির অন্যতম বিষয় ধর্মীয় অসঙ্গতির সমালোচনা।

বাংলাদেশে সেকুলার বই প্রকাশনার অন্যতম প্লাটফর্ম শুদ্ধস্বরের শুরু থেকেই আমি এর সাথে আছি। ২০০৪ সালে যে দুটো বই দিয়ে শুদ্ধস্বর প্রকাশনী শুরু হয় তার একটি আমার। বাংলাদেশে ২০১৩ সাল থেকে মৌলবাদীদের হাতে খুন ও আক্রমণের শিকার মুক্তমনা লেখকদের অনেকেই আমার ব্যক্তিগত বন্ধু।

photo 4.jpg
ঢাকার একুশে বইমেলায় অভিজিৎ রায় (ডানে) বন্যা আহমেদ (ডান থেকে দ্বিতীয়) মাহবুব লীলেন (ডান থেকে তৃতীয়) রণদীপম বসু (বামে) ও আহমেদুর রশীদ চৌধুরী (বাম থেকে দ্বিতীয়)। ফেব্রুয়ারি ২০১৫। (ছবি: শুভজিৎ ভৌমিক)

বাংলাদেশে সমকামী লেখকদের প্রথম ম্যাগাজিন 'রূপকল্প'২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একুশে বইমেলায় প্রকাশ করে শুদ্ধস্বর। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অন্য অনেকের সাথে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়, বন্যা আহমেদ, ছিলাম আমিও। ওই দিন মেলা শেষে ফেরার পথে মৌলবাদীরা অভিজিতকে কুপিয়ে হত্যা করে, হামলায় মারাত্মক আহত হন বন্যা।

সেই সংবাদ শুনে দিনা চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করে। অভিজিৎ তারও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মায়ের কান্না দেখে দু বছরের মেয়েও কাঁদতে থাকে। কিন্তু আমি না পারি চিৎকার দিতে, না পারি কাঁদতে। ফেসবুকে একটা কার্ড বানিয়ে লাল অক্ষরে শুধু লিখি, “অভিজিৎ রায় হত্যা/এ মৃত্যু আমারও।”

photo 5.jpg
অভিজিৎ রায় হত্যার রাতে ফেসবুকে দেয়া আমার পোস্টের স্ক্রিনশট। (ছবি: মাহবুব লীলেন)

গুটিয়ে এলো বলা ও লেখা

আমরা ভয় পেতে শুরু করলাম। সরকারের প্রভাবশালীরা হত্যাকাণ্ডের দায় নিহতের ওপর চাপাতে থাকলেন। বললেন, ধর্মের সমালোচনা করলে তার দায় নিতে হবে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন ধর্মের অবমাননা সহ্য করা হবে না।

সরকারের প্রশ্রয় পেয়ে মৌলবাদীরা প্রকাশ্যেই শুরু করল হুমকি ধামকি।

বাংলাদেশ সংকুচিত হয়ে এলো আমাদের কথা বলা ও লেখার স্থান। প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো নতুন কোনো লেখা প্রকাশ। কিন্তু আমরা যা লিখেছি, যা প্রকাশ করেছি, তা তখনো বহন করছিল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি।

স্বজন ও বন্ধুরা দেশ ছাড়ার পরামর্শ দিলেও আমার অনীহা ছিল। ঢাকার কল্যাণপুরে তখন মাত্র দুটো ফ্লাট কিনেছি। ২০১৫ সালের জুন থেকে একটা ভাড়া দিয়ে আরেকটায় থাকার জন্য একটু একটু করে সাজাই। একটা বুকশেলফ তৈরি হয়েছে, আরেকটা তৈরির জন্য কাঠ কেনা হয়েছে মাত্র।

এর মাঝে ৩১ অক্টোবর শনিবার লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের অফিসে মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হলেন প্রকাশক ও সম্পাদক আহমেদুর রশীদ টুটুল, লেখক রণদীপম বসু আর তারেক রহীম।

টুটুল, রণদা আর তারেককে দেখতে হাসপাতালে গিয়ে শুনি একই দিনে একই সময়ে শাহবাগে জাগৃতি প্রকাশনীর অফিসে আক্রমণে মারা গেছেন প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন

হামলার পরদিন হাসপাতাল থেকে টুটুল বার্তা পাঠায়, “যত শীঘ্র সম্ভব দেশের বাইরে যাবার চেষ্টা করো।”

Salman Rushdee Mahbub Leelen.jpg
নিউ ইয়র্কে শুদ্ধস্বরের পক্ষে ফ্রিডম টু পাবলিশ অ্যাওয়ার্ড গ্রহণের পর পেন লিটারারি গালায় উপন্যাসিক সালমান রুশদির (বামে) সাথে। ১৬ মে ২০১৬। (সৌজন্যে: মাহবুব লীলেন)

শৈশবেই নিজের বাবাকে হারিয়েছে দিনা। বলল, “বাংলাদেশে বাবা ছাড়া একটা মেয়ের জন্য বড়ো হওয়া কতটা কঠিন আমি জানি। আমি চাই না আমার মেয়েটা পিতৃহীন হোক। দেশে আর থাকা যাবে না।”

দিনার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মাত্র কথা বলতে শেখা মেয়ে প্রান্তীকে জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা ভেতরের কষ্ট কী জিনিস বোঝেন?”

“না,” দু বছর বয়সী মেয়ের পরিষ্কার উত্তর।

আর কারো সাথে কোনো কথা বলিনি। প্রকাশ্য চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেলো। এর দেড় মাস পরে সব ফেলে বৌ বাচ্চা নিয়ে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আমেরিকায় এসে উঠলাম ছোট বোন জেরীনের বাসায়।

আমেরিকা আসার পর অনলাইনে আক্রমণের শিকার হতে থাকল দিনা। দিনার লেখালেখির মূল বিষয় নারী স্বাধীনতা। নারীদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় অসংগতিগুলো তার লেখায় ঘুরে ফিরে আসে, ফলে নিয়মিতই তাকে শিকার হতে হয় নোংরা আক্রমণ ও হুমকির।

তবু আমরা ভেবেছি, বাংলাদেশে যারা আছে তারা তো কেউ ধর্মের সমালোচনা করে না, তারা নিশ্চয়ই নিরাপদে থাকবে। কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেখলাম, আমাদের ধারণা ভুল।

দুর্গতি ছাড়ে না, বাড়ে

গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আমার যে ভাই আওয়ামী লীগ করত, সে যেমন মামলা ও হামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, যে ভাই শুধুই যুক্ত ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সেও পলাতক একই কারণে।

একই কারণে পেশাগত দুর্গতি বয়ে বেড়াচ্ছে বিএনপি করা আমার আরেক ভাই আর ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে আমার এক বোনের পরিবার।

আমার মা বাবার ষষ্ঠ সন্তান নাজমুল আলম রোমেন সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত। সে জাতীয় শ্রমিক লীগের সিলেট মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক, গত সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৪ আসনের দলীয় মনোনয়নপ্রার্থীও ছিল। দলের মনোনয়ন না পেয়ে আর নির্বাচন করেনি। গত বছর মার্চের শুরুতে আমেরিকায় আসে মা কে দেখতে। মা ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে নিউ ইয়র্কে জেরীনের সাথে থাকেন।

৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর দলে দলে লোক একাধিকবার রোমেনকে খুঁজতে বাসায় গিয়ে হাজির হয়। আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের মতো জুলাই-আগস্টে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার অভিযোগে তার বিরুদ্ধেও এখন প্রায় আধা ডজন মামলা।

“ভেবেছিলাম কয়েক মাস পর দেশে গিয়ে পরের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেবো। কিন্তু এখন দেশে গেলে হয় আমাকে আক্রমণের শিকার হতে হবে, না হয় জেলে যেতে হবে। অথচ আমি তো গত মার্চ থেকেই দেশের বাইরে,” নিউ ইয়র্ক থেকে বলে রোমেন।

“বুঝতে পারছি না আমার দুটো বাচ্চার কী হবে, আমি না পারছি তাদের কাছে যেতে, না পারছি তাদেরকে আমার কাছে আনতে।”

রোমেনের ছেলের বয়স চার, মেয়ের বয়স দুই। দুটো সন্তানকে নিয়ে এখন নিরাপত্তার জন্য লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে তার স্ত্রীকে।

আমার বড়ো ভাই গীতিকার শামসুল আলম সেলিম। বর্তমানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সিলেট এর সভাপতি। আগাগোড়াই তিনি একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক, তিনিও এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন হামলার আশঙ্কা আর ভিত্তিহীন বিস্ফোরক আইনের মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে।

আগস্টে সরকার পতনের পর সংস্কৃতি কর্মীদের ওপর আক্রমণ ও মামলা হতে থাকে। আগস্টের শুরুতেই ভাইয়াকে খুঁজতে অপরিচিত একদল লোক তার বাসায় যায়। তিনি বাসা থেকে সরে যান।

দু মাসের বেশি পালিয়ে থাকার পর ভাইয়া যখন বাসায় ফেরার কথা ভাবছেন, ঠিক তখনই অক্টোবরের ২৭ তারিখ তাঁকে সিলেট সিটি মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সাথে একটি বিস্ফোরক আইনের মামলায় আসামি করা হয়।

তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নাকি জুলাই মাসে আন্দোলনকারীদের ওপর বিস্ফোরক দিয়ে হামলা করেছেন এবং হামলার উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক বহন করেছেন।

“সারা জীবন থেকেছি মানুষের মধ্যে, সেই আমি, ছয় মাস ধরে পালিয়ে আছি, না সোশ্যাল মিডিয়া, না ফোন। একেবারে একা। এভাবে বেশিদিন থাকলে মনে হয় পাগল হয়ে যাব,” ভাইয়া জানায়।

সেলিম আর রোমেন, আমার এই দুই ভাই জন্ম থেকে বেড়ে উঠেছে সিলেটের মতো ছোট শহরে, যেখানে সবাই সবাইকে চেনে। কোনোদিনও তাদের নামে কেউ কোনো সহিংসতার অভিযোগ করেনি। কিন্তু রাজনীতি বদলে যাওয়ায়, এখন তাদেরকেও পালিয়ে বেড়াতে হয় সহিংসতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে।

সরকার বদলের পর শুধু সাংস্কৃতিক কর্মীরাই নয়, সাংস্কৃতিক সংগঠনের ওপরও আক্রমণ শুরু হয়। ঢাকায় আমি যুক্ত ছিলাম নাটকের দল দেশ নাটকের সাথে। গত নভেম্বরের ২ তারিখ ঢাকার শিল্পকলা মঞ্চে সংগঠনের নিত্যপুরাণ নাটক প্রদর্শনীর মাঝামাঝি এসে এক দল লোক দাবি জানায় দলের এক সদস্যকে তাঁদের হাতে তুলে দিতে হবে। কারণ সেই সদস্য আওয়ামী লীগের সমর্থক।

দল এমন দাবি মানতে অস্বীকার করায় তারা শিল্পকলা ভবনে আগুন লাগিয়ে দেবার হুমকি দেয়, এই পরিস্থিতিতে শিল্পকলার মহাপরিচালক নাটকটির প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধ করে দেন

আমার মা-বাবার পঞ্চম সন্তান মোহাম্মদ পলেন ছাত্র জীবনে যুক্ত ছিল বিএনপি রাজনীতির সাথে, পেশাজীবনে এস আলম সিমেন্ট এর মার্কেটিং বিভাগের প্রধান। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে এস আলম সিমেন্টও বন্ধ হয়ে যায়

“কেউ আমাদের বরখাস্ত করেনি, কিন্তু আমাদের বেতন দেবার মতো কেউ নেই। ফ্যাক্টরি বন্ধ, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ, গাড়িসহ অনেক কিছুই লুট হয়ে গেছে, প্রডাকশন নেই, ব্যবসাও নাই। এই হলো অবস্থা,” চট্টগ্রাম থেকে জানায় পলেন।

“বাংলাদেশে এখন কোনো কোম্পানিই নতুন নিয়োগ দিচ্ছে না, সবাই চেষ্টায় আছে সরকারকে বোঝার। কিন্তু আমি কীভাবে আমার মেয়েদের এই সংকট বোঝাব,” বলে ছোট ছোট তিন মেয়ের বাবা পলেন।

Benar_ Mahbub Leelen_102a.JPG
Benar News journalist Mahbub Leelen ভার্জিনিয়ার আলেক্সান্দ্রিয়ায় নিজেদের বাড়ির সামনে ছেলে জিয়ল প্রহরকে কোলে নিয়ে লীলেন, স্ত্রী দিনা ফেরদৌস (ডান থেকে দ্বিতীয়) ও মেয়ে পাললিক প্রান্তী। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। (গ্যামুনু আমারাসিংহা/আরএফএ) (Gemunu Amarasinghe/Gemunu Amarasinghe/RFA)

' আমি ভয়ে আছি '

বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান, আমার বোন রোমানা কিরণ বিয়ে করেছে এক খ্রিস্টান ছেলেকে। কিরণ ধর্মে উদাসীন হলেও তার স্বামী অনিসিমাস চৌধুরী অনি সক্রিয় ধার্মিক। বর্তমানে সুনামগঞ্জের একটা চার্চের কোষাধ্যক্ষ সে।

“আমি হলাম গিয়ে সংখ্যালঘুদের ভেতর সংখ্যালঘুতম। আগস্টের পরে আমার পারিবারিক কবরস্থানের একটা অংশ স্থানীয় হিন্দুরা দখল করে শ্মশানঘাটের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছে,” জানায় অনি।

“এক টুকরা জমি বিক্রি করে বায়না নিয়েছিলাম, বায়নার দুই লাখ টাকা জোর করে নিয়ে গেছে এক বিএনপির কর্মী, সে আবার ধর্মে মুসলমান। সুতরাং আপনিই ঠিক করেন আমি কেমন আছি।”

সরকার পরিবর্তনের পর কেমন আছে জিজ্ঞেস করায় বলতে থাকে অনি, “আমাকে এখন পর্যন্ত সরাসরি কেউ আক্রমণ করেনি, ধমকও দেয়নি, কিন্তু আমি ভয়ে আছি। আগেও যে খুব নির্ভয়ে থাকতাম তা নয়, কিন্তু আগে জানতাম কোথায় সহায়তা পাওয়া যাবে। এখন আমি জানি না কোথায় সাহায্য পাওয়া যাবে। থানা আছে, কিন্তু সেখানে আমার মতো মানুষের জন্য পুলিশ নেই।”

অনি প্রতি বছরই নিজের বাড়ি আলো দিয়ে সাজিয়ে ঘটা করে বড়দিন করে। কিন্তু গত বড়দিনে সে কোনো উৎসব করেনি।

“এবার শুধু প্রার্থনা করেই বড়দিন করেছি। বাড়িতে লাইটিংও করিনি, কাউকে নিমন্ত্রণও করিনি। আমি নিরাপদ বোধ করিনি,” অনি জানায়।

“আমি ছাড়া আমার অসুস্থ মাকে দেখারও কেউ নেই। তাঁকে একা রেখে যেমন আমি কোথাও সরতে পারব না, তার মতো একজন বয়স্ক অসুস্থ মানুষকে নিয়ে তো কোথাও যাওয়াও সম্ভব না। সুতরাং, বাড়িতে বসেই দুর্ভাগ্যের অপেক্ষা ছাড়া আমার কিছু করার নেই।”

“আগস্টের পরে আমার অবস্থা নিয়ে বহু কিছু বলার আছে, কিন্তু বলি না, আমি ভয়ে আছি ভাইয়া,” অনি তার অবস্থার উপসংহার টানে।

আমেরিকায় আসার পর আমি এখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছি। আমার সেই আবেদন এখনো অপেক্ষমাণ, বিবেচনা হতেও পারে, নাও হতে পারে। যদি সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়, তবে এই দেশে থাকার কোনো অধিকার থাকবে না আমার।

আমার অধিকার ছিল বাংলাদেশে। বাকস্বাধীনতার চর্চা করতে গিয়ে নিজের সেই দেশ ছাড়তে হয়েছে আমাকে। আমার যেসব ভাইবোন ধর্মের সমালোচনা করে না, এখন তাদের জন্যও কঠিন হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে বসবাস।

মাঝে মাঝেই মনে হয়, এমন কোনো দিন কি আদৌ আসবে, যেদিন আমরা সাত ভাইবোন বাংলাদেশে নিজের বাড়িতে আবার একটা গ্রুপ ছবি তুলতে পারব?

সম্ভবত না। আর কোনোদিনও আসবে না তেমন দিন।